
প্রথম পর্ব: সত্যের অন্বেষণ
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার এক নিভৃত কাল্পনিক জনপদ ‘জয়গড়’। আপাতদৃষ্টিতে শান্ত এই জনপদের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক রহস্যময় অরণ্য, যার নাম ‘গোলকধাঁধা’। লোকমুখে প্রচলিত, এই গহীন বনের ওপারে লুকিয়ে আছে এক জাদুকরী দিঘি। সেই দিঘির পবিত্র জল চোখে লাগালেই মানুষের চোখের সামনে থেকে ঘুচে যায় সব মিথ্যার মায়া, উন্মোচিত হয় পরম সত্য।
এই রোমাঞ্চকর পটভূমিতেই গড়ে উঠেছে গল্পের নায়ক আরাফাত রহমান প্রিন্সের সত্য সন্ধানের দুঃসাহসী যাত্রা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা মিথ্যার বেড়াজাল ছিন্ন করাই তার মূল লক্ষ্য। তবে এই পথচলা ছিল অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ।
যাত্রাপথে তাকে বারবার বাধা দেয় শত শত ‘এঁড়ে বিড়াল’ ও ‘নেড়ে বিড়াল’। এরা মূলত সমাজের সেই সংকীর্ণমনা ও কুচক্রী শ্রেণির প্রতীক, যারা শুভ কাজে অহেতুক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সত্যের পথকে বিভ্রান্ত করতে চায়। গল্পের সবচেয়ে রোমহর্ষক বাঁক আসে যখন প্রিন্সকে পাড়ি দিতে হয় উত্তাল ‘দাড়াইন নদী’। সেখানে জলের নিচে ওত পেতে আছে বিশাল সব ‘রাঘব বোয়াল’ ও ‘হাঙ্গর’। এরা সমাজের সেই সব প্রভাবশালী অপশক্তির প্রতীক, যারা সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করে এবং ক্ষমতার দাপটে সত্যের কণ্ঠরোধ করতে চায়।
কিন্তু কোনো ভয়, সংশয় বা প্রলোভনই অকুতোভয় প্রিন্সকে দমাতে পারেনি। অদম্য মনোবল নিয়ে নদী ও বনের শত বাধা পেরিয়ে সে শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় সেই আকাঙ্ক্ষিত দিঘির পাড়ে। দিঘির জলের স্পর্শে তার চোখের সামনে উন্মোচিত হয় এক নতুন জগৎ। সে মর্মে মর্মে অনুভব করে, সাধারণ মানুষ কীভাবে অদৃশ্য ভয় আর মিথ্যার শিকলে বন্দি হয়ে আছে। অবশেষে সেই মায়াবী অন্ধকার ভেদ করে সত্যের মশাল হাতে জয়গড় গ্রামে ফিরে আসে এক অন্যরকম রূপান্তরিত প্রিন্স। তার হাতের সেই জ্বলন্ত মশাল কেবল আলোর উৎস নয়, বরং অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে এক অবিনাশী প্রতিরোধের শাশ্বত প্রতীক।
দ্বিতীয় পর্ব: মিথ্যার অবসান ও জাগরণ
সত্যের মশাল হাতে জয়গড় গ্রামে পা রাখতেই প্রিন্স লক্ষ্য করল, পরিবেশটা আগের মতো নেই। তার হাতের সেই দৈব আলোয় গ্রামের চেনা মানুষগুলোর মুখ অন্যরকম দেখাচ্ছে। যারা এতদিন মিথ্যার আবরণে নিজেদের ঢেকে রেখেছিল, মশালের তীব্র আলোয় তাদের আসল রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
গ্রামের মোড়ে মোড়ে এখনো সেই ‘এঁড়ে বিড়াল’ আর ‘নেড়ে বিড়ালদের’ আনাগোনা। প্রিন্সকে দেখে তারা আগের মতো আর তেড়ে আসতে সাহস পাচ্ছে না, বরং আলোর ভয়ে অন্ধকারের কোণে গা ঢাকা দিচ্ছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা ছিল অন্য জায়গায়। মায়াবী দিঘির জল চোখে লাগিয়ে প্রিন্স যে সত্য দেখতে পাচ্ছে, সাধারণ গ্রামবাসী তো তা দেখতে পাচ্ছে না। তারা এখনো সেই ‘রাঘব বোয়াল’ আর ‘হাঙ্গরদের’ ভয়ে তটস্থ, যারা দাড়াইন নদীর ওপার থেকে পুরো জয়গড়কে নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
এক রাতে প্রিন্স খবর পেল, গ্রামের সাধারণ কৃষকদের জমি দখল করার জন্য প্রভাবশালী সেই ‘রাঘব বোয়ালরা’ নতুন এক চক্রান্ত জাল বুনেছে। তারা গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যে, ‘গোলকধাঁধা’ অরণ্যের ওপারে এক অভিশাপ আছে, যা কেবল তাদের কথা শুনলেই কাটবে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত আর ভীত। প্রিন্স বুঝতে পারল, শুধু মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না, এই আলো সবার অন্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সে গ্রামবাসীদের জমায়েত করল দাড়াইন নদীর তীরে। সেই বিশাল রাঘব বোয়ালরা জলের নিচে হুংকার দিচ্ছে, ঢেউ তুলে নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। প্রিন্স ধীর পায়ে জলের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো। সে চেঁচিয়ে বলল, “ভয় পেও না জয়গড়বাসী! যে অন্ধকার তোমাদের বন্দি করে রেখেছে, তা কেবল তোমাদের চোখের ভুল। সত্যের একটা কণা এই বিশাল মিথ্যার সাগরকে শুকিয়ে দিতে পারে।”
সে তার ঝোলা থেকে মায়াবী দিঘির সেই পবিত্র জল ছিটিয়ে দিল নদীর জলে। মুহূর্তের মধ্যে এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটল! ঘোলাটে জল কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠল। গ্রামবাসী অবাক হয়ে দেখল, জলের নিচে যাদের তারা ‘দানবীয় হাঙ্গর’ ভেবে ভয় পাচ্ছিল, তারা আসলে খড়কুটো আর পাথরের আড়ালে লুকানো ক্ষুদ্র কিছু কীট মাত্র—যারা কেবল ছায়ার কারসাজিতে নিজেদের বড় করে তুলে ধরেছিল।
মিথ্যার মায়া কাটতেই গ্রামবাসীদের মনে সাহসের সঞ্চার হলো। তারা একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ালো। সেই সংকীর্ণমনা কুচক্রী আর প্রভাবশালী অপশক্তিগুলো লেজ গুটিয়ে অরণ্যের গভীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জয়গড় যেন এক নতুন জনপদ হিসেবে জেগে উঠল। প্রিন্স জানত, সত্যের এই লড়াই কোনো একদিনের নয়; মশালটি জ্বালিয়ে রাখতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সে গ্রামের মাঝখানে এক উঁচুটিলায় মশালটি স্থাপন করল, যা এখন জয়গড়ের আলোকবর্তিকা।
সত্য সন্ধানী এক যুবকের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল নিভৃত অরণ্যে, তা আজ জয়গড়ের প্রতিটি ঘরে ঘরে মুক্তির গান হয়ে বেজে উঠছে। মিথ্যার বেড়াজাল ছিন্ন করে জয়গড় এখন সত্যের এক অপরাজেয় দুর্গ।
আপনার মতামত লিখুন :