বাঙালির চিয়ায়ত ঋতুবৈচিত্রে হেমন্তকে বলা হয় লক্ষ্মী ঋতু। ষড়ঋতুতে ঋতুরাজ বসন্ত হলেও অন্যতম লাজুক ঋতু বলা হয় হেমন্তকে। কারণ এই ঋতু ঘিরে বাংলাসাহিত্যে রচিত হয় নানাবিধ সাহিত্যকর্ম। গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা কবিতা। কবিতার কবি আরও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে এই ঋতুতে। কবিতা সেজে ওঠে নিজস্ব ঢঙয়ে। কবিতার রূপ-রস-গন্ধ ছড়িয়ে যায় নবান্নের সুরভির মতো। শিউলি, কামিনী, মল্লিকার সুরভিতে সুরভিত হয় চারদিক। অগ্রহায়ণে পায়েশের শুভ্রতায় প্রাণ ফিরে পায় জীর্ণতা। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়েই হেমন্ত কাল। প্রচলিত তথ্যমতে, ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ নামের দুটি তারার নামে ‘কার্তিক’ ও ‘অগ্রহায়ণ’ নামের উৎপত্তি। এখানে ‘অগ্র’ অর্থ ধান এবং ‘হায়ণ’ অর্থ কাটার মৌসুম। এজন্য অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন সম্রাট আকবর। নবান্ন উৎসব শুরু হয় এ ঋতুতে। নবান্নকে নিয়ে হরেকরকম সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। বাঙালির সংস্কৃতিতে নবান্ন একটি অন্যতম অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত যা আমাদেরকে নতুনভাবে শিখতেও সাহায্য করে। নবান্নকে নিয়ে কবিতায় উঠে এসেছে নানাবিধ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। কিষাণীর উঠোনের ধুলোর গন্ধ কবিতার শরীরের সাথে মিশে যায় নিপুণভাবে। এ ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে শীতের আমেজ। গ্রামীণ জনপদে থাকে হালকা শীতের আমেজ। আকাশ থেকে খ- খ- মেঘ সরে গিয়ে উদোম হয়েছে বিশাল নীল আকাশ। কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায়-
‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে…।
হেমন্ত ঋতুর শুরুতেই প্রকৃতিতে শুরু হয় রং বদলের খেলা। ভোরে হালকা কূয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য যখন দীপ্তি ছড়ায় তখনই চোখে পড়ে শিশিরের কারচুপি মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির জমতে শুরু করে ঘাসের ডগায়, ধানের শীষে। আদিগন্ত মাঠ জুড়ে ধানের প্রাচুর্য সোনালী রং ছড়ায়। হলুদে-সবুজে একাকার অপরূপ প্রকৃতি। চারদিকে ধূসর আবহ ঘিরে শেষ বিকালে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে রাখে শিশিরে মায়াবী মায়ায়। এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই কবি বলে ওঠেন-
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর /হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/
কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে..।
আর এই সময়ে কৃষাণ-কৃষাণীরা মেতে ওঠে ফসলের আরাধনায়। ফসলি মাঠ ভরে ওঠে ফসলের মৌ মৌ গন্ধে মেঘমালা আর শীতের হাওয়া দোলা দেয় আমাদের মনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৈবদ্যে স্তব্ধতা কবিতায় লিখেছেন :
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে /জনশূণ্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে /শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার / স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
সমকালীন কবিতায়ও দেখা যায়; কবি, মানুষের মুখের কথাগুলো তুলে ধরেছেন অন্যভাবে। কবিতায় মূলকথা সরাসরি প্রকাশ না করে একটু-আধটু রূপক-উপমার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে কবিতায় যেমনি দর্শনক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, সাথে সাথে সহজবোধ্য কিংবা দুর্বোধ্যতার বিষয়টিও উঠে এসেছে পাঠকমহলে। আলোচনা-সমালোচনা কিংবা মতামত প্রকাশের মাধ্যমও তৈরি হয়েছে যথার্থই। মোস্তাক আহমাদ দীন তার অঘ্রাণী কবিতায় উল্লেখ করেছেন এভাবে :
‘অতনু ঘাসের ঘ্রাণ ফেলে রেখে / আমি আজ অঘ্রাণের খোঁজে।/ ওই মাঠ কতটা ভিজেছে দেখো
ধানের বৃষ্টিতে। / সোনার খেতের পাশে /কতটা পয়মন্ত হয় দেখি/ অঘ্রাণি, তোমার শরীর।’
রূপসী বাংলায় মৌ মৌ সুঘ্রাণে উদাসীন হাওয়ায় এই শিশিরার্দ্র দু’মাস মিলে বাংলার প্রকৃতিকে স্বর্ণালি অলংকার পড়িয়ে নববধূরূপে সাজিয়ে বাঙালির সম্পূর্ণ নিজস্ব ঋতু হেমন্তের আগমন ঘটে। এই মিষ্টি-কোমল শিশিরের স্পর্শযুক্ত হেমন্ত হলো শান্ত, সৌম, উদাসীন, মগ্ন, নিভৃত, খরতাপমুক্ত। হেমন্তের এ ঝরা পাতা দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘ঝরা পাতা গো, বসন্তী রঙ দিয়ে/ শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ’। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু হেমন্ত। হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়-এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’
হেমন্তজীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য সময় হয়ে ওঠে। বর্ষার পরে এই সময়ে বৃক্ষরাজি থাকে সবুজে ভরা। ভরা থাকে খাল-বিল নদী-নালা। বিল জুড়ে সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের সমারোহ। এই হেমন্তের দুই রূপ প্রতিভাত হয়। প্রথম মাসটির এক রূপ। পরেরটির অন্য। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এ সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। কবি গুরুর কবিতায়ও আভাস পাওয়া যায় মন্দ্রাক্রান্ত কার্তিকের। কবিগুরু লিখেছেন- ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান, কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’
বাঙালির নান্দনিক ভাবনায় ‘বসন্ত’ ঋতুরাজের মর্যাদা পেয়েছে যত না, এ ঋতুর প্রভাব-প্রতিপত্তিতে, এর চেয়েও বেশি পাশ্চাত্যের অনুকরণে, বিশেষত ইংরেজি কবিতার পঠন-পাঠন থেকে সৃষ্ট সংবেদনশীলতায়। বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বর্ষা ও শরৎ, কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় গ্রীষ্ম আর জীবনানন্দের রচনায় হেমন্ত ও শীত। বাংলা কবিতায় হেমন্তের কথা উঠলে সর্বাগ্রেই মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কথা। ‘ধান কাটা’, ‘নবান্ন’, ‘ইঁদুর’, ‘শালিক পাখি’ আর ‘লক্ষ্মীপেঁচা’র যে উল্লেখ দেখি জীবনানন্দ দাশের উত্থান পর্বের অনেক কবিতায়, তাতে তাঁকে ‘হেমন্তের কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত করলেও অত্যুক্তি হবে না। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত প্রাণ পেয়েছে তার দ্বৈত সত্তা নিয়ে। জীবনানন্দ হেমন্ত ঋতুকে ব্যবহার করেছেন মূলত বিনষ্টি, ক্ষয়িষ্ণুতা ও মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে, আবার একই সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উৎসবের কাল হিসেবে। একদিকে ‘নবান্নের ঘ্রাণ’ আর অন্যদিকে শিশিরসিক্ত ‘নির্জন স্বাক্ষর’ বহন করে হেমন্ত ঋতু জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রিত হয়েছে এক অন্যরকমের দ্যোতনায়।
‘চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল/তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!/প্রচুর শস্যের গন্ধ বুকে তার থেকে আসিতেছে ভেসে/পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশ’; ‘হেমন্তের রৌদ্রের মতন/ফসলের স্তন/আঙুলে নিঙাড়ি/এই ক্ষেতে ছাড়ি/অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে/এ-সবুজ দেশে/আরো একবার।
হেমন্তে দিন ছোট হয়ে আসে অর্থাৎ বেলা দ্রুত চলে যায়- তাই অপরাহ্নে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের প্রান্তে দেখা যায় নীল কুয়াশার চাদর দিয়ে ঢাকা এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে রক্তিম বর্ণে রূপ নিয়ে এক মায়াবী নিঝুম পরিবেশ সৃষ্টি করে- চারিদিকে নেমে আসে নির্জনতার ছাপ- পাখিরা ক্লান্ত দেহে নীড়ে ফিরে যায়- এরকম রহস্যময় নীরবতার দৃশ্য হেমন্ত ছাড়া অন্য ঋতুতে দেখা যায় না। খেজুর গাছ পরিষ্কার করে রসের জন্য মাটির কলস গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয়ার এই তো সময়- খেজুর গাছের গ্রামবাংলার এই শাশ্বত রূপ হেমন্ত ঋতুর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে হেমন্তের অনিন্দ্যসুন্দর রূপলাবণ্য অপরূপ রূপকে দেখতে হলে দু’চোখ খোলা রেখে তৃতীয় নয়নে দেখতে হবে- কারণ হেমন্ত হলো অনুভবের ঋতু- তাই এই স্বপ্নময় গভীর ও গম্ভীর প্রাণ ভুলানো অপূর্ব রূপকে দেখতে হলে সেরকম প্রকৃতিপ্রেমীও হতে হবে। এসময় মন-খারাপ-করা বিকেলে হেমন্তের ম্লান রোদ বিড়ালের মতো জানালা টপকে ঘরে নামবে। হেমন্ত রাতের কুয়াশায় দুঃখী চেহারার ম্লান চাঁদ গাছের ডালে ঝুলে থাকে । এমনি করেই বাংলার প্রিয় ষড়ঋতু ফিরে আসে বারবার, যুগের পর যুগ।
আর ধান কাটা শেষ হলে গ্রামবাংলা উৎসবের আমেজে মেতে উঠবে। নবান্নের আনন্দধারা তখন ঘরে ঘরে। ফসল তোলা শেষে পড়ে থাকে রিক্ত রুক্ষ শস্যহীন এক বিশাল প্রান্তর, শূন্যতায় ভরা যেখানে ধূলি উড়িয়ে কী যেন খুঁজে বেড়ায় বাতাস। দুপুরে ক্লান্ত চিলের কান্না প্রকৃতির এই রিক্ততাকে ছড়িয়ে দেয় চরাচরে। তৃপ্তি আর শূন্যতা দুই প্রান্তিক অবস্থানের একটি দো-রোখা শাল যেন জড়িয়ে আছে লাবণ্যমাখা এই ঋতুটির গায়ে। এমনি করেই হেমন্ত আসে প্রতিবছর। হেমন্ত আসবে আরও বহুদিন ধরে। সেদিনও সঙ্গে নিয়ে আসবে কার্তিকের নবান্ন, শিশিরের ঘ্রাণ, কমলা রঙের রোদ আর কাস্তের মতো বাঁকা মেঠো চাঁদ। সেই অনাগত দিনের কবিরা ও ঋতু-বন্দনায় অক্ষর গেঁথে যাবেন, যেমন গেঁথেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ।
হেমন্তকে কবিরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখেছেন। ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে তাই তাদের কবিতায়। কবিতায় উঠে এসেছে শিশিরস্নাত ভোরবেলা, মিষ্টি সোনারোদ, বিমুগ্ধ দুপুর, মেঘমুক্ত বিকেল, কুয়াশায় ভিজে যাওয়া পাতার সংসার নিয়ে সন্ধ্যা আর মুখরিত রাত। সেই সাথে নতুনভাবে যুক্ত হয় পিঠাপুলির উৎসব। বাংলার এসব প্রথা দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে, পরিবর্তন এসেছে বাংলা সাহিত্যের কবিতায়ও। যেমন নাসির আহমেদ তার ‘এই দৃশ্য শুধু সম্ভাবনা’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন :
‘ওই যে সবুজ ছুঁয়ে সন্ধ্যা নামে দেখো আসলে সবুজ নয়
এ হলো কবির কল্পনার বনভূমি এবং সন্ধ্যার মতো
কুয়াশার গাঢ় কিছু চিত্রকল্প, যার প্রান্ত ছুঁয়ে ফুটে আছে
কমলালেবুর মতো লাল সূর্য, চিত্রকল্পে সন্ধ্যা মনে হয়।’
আবার অন্য দিকে গ্রামীণ একটি প্রবাদও আছে, ‘ঠেলা যায় হাত্তিকে, ঠেলা যায় না কার্তিককে।’ কারণ এই সময় অধিকাংশ কৃষকের ঘরে ফসলের মজুদ কমে আসে, ফলে শুরু হয় খাদ্যের অভাব। তাই কার্তিক মাসকেই বরাবরই গ্রামের সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে থাকে। অভাবকে মোকাবেলা করে চলতে থাকে নতুন ফসল তোলার প্রস্তুতি, সেক্ষেত্রে হেমন্তের নতুন ফসল উঠলে পেছনের দুঃখময় দিনগুলোর কষ্ট মুছে যায় তাদের অজান্তেই। শুরু হয় নতুন করে খাদ্য মজুদের এক মহাসমারোহ। কবি তার কবিতায় তুলে আনেন এইসব দিনরাত্রির উপাখ্যান। সুজাউদ্দিন কায়সার ‘নিরাপদ উজ্জ্বলতা’
কবিতায় বলেছেন :
‘তোমার বহিরঙ্গে আজ তবু কেন এত অহেতুক
রূঢ়তা? কী রকম বিষমাখা এ রকম প্রতিহিংসা?
স্মৃতি-বিস্মৃতির পরিক্রমা মনে হয় রো ভুলে যাবে ভাবনার বিনিময়
অফুরান চিরায়ত এসব বর্ণময় বস্তুময় তুমি
স্বরূপে অবহিত জীবন কেবল সন্ধানে চাও
প্রক্ষালিত হতে
নিকটবর্তী যা জেনেছ তাও জানো অনুচ্চ
প্রকৃত সুস্থতা নিয়ে নিরাপদ উজ্জ্বলতা জড়াবে অনুভূতি’
এই হেমন্তে দেখা মেলে ফসলি মাঠের এক প্রাণবন্ত উজ্জ্বলতা। এই প্রাণবন্ত জীবন-জীবিকা ফুটে উঠেছে কবিতার বিভিন্ন খেরো খাতায়। বলা হয় হেমন্তের ষোল আনা কবি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় উঠে এসেছে সৌন্দর্যের কারুকার্য। তবে হেমন্ত-ভাবনায় শামসুর রাহমান ছিলেন জীবনানন্দীয় চিত্রকল্পের বিপরীতে। আবার আল মাহমুদের কবিতায় হেমন্ত ধরা দিয়েছে মানুষের প্রেমে-কামে প্রকৃতির নবলোকে। দেখা যায় পূর্ণাঙ্গরূপ আল মাহমুদের কবিতায় তিনি অঘ্রাণ কবিতায় লিখেছেন :
‘আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে
আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে।
রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে’
প্রকৃতির সাথে মানুষের অস্তিত্বের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে মিশে আছে আদিকাল থেকেই। প্রকৃতি ব্যতীত মানুষ কল্পনা করা অসম্ভব। প্রকৃতির উপর এক বিশ্বস্ত অভিধানের পাতা আগেই মেলে গেছে। প্রকৃতি ও মানবজীবনের সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ নিপুণভাবে হেমন্তের ছবি এঁকেছেন :
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল
পৃথিবীর সব রং মুছে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রং ঝিলিমিল
সব পাখি ঘরে আসে
সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
এ সময় মাঠের সোনালি ফসল পাকতে শুরু করে। তারপর ঘরে তোলার পালা। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষাণীরা ধান শুকোতে ব্যস্ত। এখন আগের সে অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। অগ্রহায়ণ পুরোটাজুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এখন প্রকৃতি যেন আর নিয়ম মানছে না। কেমন খামখেয়ালী হয়ে উঠেছে।
শেষ করতে চাই এই বলেই ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্ত ঋতু বাঙালিদেও জীবনে ভাগ্য লক্ষী হয়ে আসে। শরতের গুমট আবহাওয়ার সমাপ্তি ঘটিয়ে হালকা শীতল বাতাস, শিশিরের ঘ্রাণ, মেঘহীন বিপুল আকাশ সন্ধ্যার হাওয়াই মিঠাই কূয়াশা সবার মনে স্বস্তি এনে দেয়, এনে দেয় অন্যরকম এক প্রশান্তি। চারিদিকে শুরু হয় ফসলের ঘ্রাণ। নতুন শাকসব্জিতে ভরে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। সর্ষেফুলের হলুদ গালিচায় মোড়া প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন সাজে। তাইতো কবিদেও এতো হেমন্ত বন্দনা।
মন্তব্য করুন