তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের ছয়হারা গ্রামের ঢালার হাওরে সনাতন ধর্মের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার দিন ব্যাপী এই পূজোর উৎসবে ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আনন্দ মুখর পরিবেশ। জানা যায় যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ফেনারবাঁক ইউনিয়নের ছয়হারা গ্রামের সামনে চৈত্র মাসের শেষ দিনে চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মাঠের আশপাশে প্রায় শতাধিক দোকানীরাও গ্রামীণ মেলায় বসে। এই চড়ক পূজার আয়োজন করেন ছয়হারা গ্রামের সনাতন ধর্মের লোকজন। চড়ক পূজাকে ঘিরে সনাতন ধর্মের লোকজনের মাঝে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পার্শ্ববর্তী খুঁজারগাঁও গ্রামেও বহু প্রাচীন এই লোকউৎসব একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চড়ক পুঁজায় মানুষের পিঠের চামড়ায় এক ধরনের লোহার হুক (বড়শী) আটকিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে সেই মানুষকে শূন্যে ঘোড়ানো হয় উচু থামের (চড়ক গাছের) সঙ্গে। চড়কপূজার এই দৃশ্য দেখতে আশপাশের এলাকার লোকজনের পদচারনায় সরব হয়ে উঠে। শহর থেকে সনাতন ধর্মালম্বীরা ও অন্যান্য ধর্ম বর্নের লোকজন চড়কপূজা দেখতে ভিড় জমান প্রতিবছরই এখানে। এলাকার বাহিরে বসবাসরত সনাতন ধর্মের অসংখ্য লোকজন ছুঠে আসেন এই পূজায় অংশ নিতে।
চড়ক পূজো দেখতে আসা শিক্ষার্থী রাজশ্রী তালুকদার বলেন, এই পুঁজোটা বছরে একবার হয়। আমাদের মনের বাসনা পূর্ণ করার আশা নিয়ে এই পুঁজায় আসি। আমাদের অনেক ভালো লাগে। আনন্দও পাই।
এলাকার সমাজকর্মী ও জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব সেক্রেটারী বাদল কৃষ্ণ দাস বলেন, এই চড়ক পূজা খুব প্রাচীন। কবে এর শুরু হয়েছিল আমরা জানিনা, তবে শুনেছি কোন এক রাজা এটা শুরু করেছিল, এ ভাবেই বংশ পরমপরায় এটি চলে আসছে। প্রতি বছরেই চৈত্র মাসের শেষ দিনে এই পুঁজা হয়, পুজাকে কেন্দ্র করে এলাকায় একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। আমরাও সবাইকে নিয়ে আনন্দ উপভোগ করি।
এ ব্যাপারে চড়ক পূজার প্রবীন সন্যাসীরা জানান, ছয়হারার চড়ক পূজায় অনেক সন্যাসী বেশ কিছুদিন ধরে এক কাপড়ে সংসার ত্যাগী হয় (স্ত্রী, পুত্র, কন্যা থেকেও পৃথক থাকে)। তারা একটা নির্দিষ্ট নিয়মের ভিতরে চলাফেরা সহ আহার, নিদ্রা করে থাকে এই দিন গুলোতে। মূল পর্বে প্রায় ঘন্টা ব্যাপী তন্ত্রমন্ত্র পাঠের পর শুরু হয় নির্ধারিত ২ জন সন্যাসীকে মাঠির গর্তে বাঁশ ও চাটাই দিয়ে এর উপর মাটি দিয়ে প্রায় আধা ঘন্টা মাটির নীচে রাখা হয়। অপর ২ জন সন্যাসীর পীঠের চামড়ায় গাঁথা হয় লোহার বড়শী। বড়শী গাঁথার পর তাদেরকে চড়ক গাছের থামের চড়কীতে শূন্যে ঝুলিয়ে ঘোড়ানো হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল দুইজন সন্যাসী পিঠে বড় দুইটি লোহার হুক (বড়শী) গাথার আগে বা পড়ে এক ফোটা রক্তও বের হয়না। সন্যাসীদের ভাষায় এ ধরনের শারিরীক কষ্ট জীবিত মানুষ ভোগ করে আধ্যাতিক শক্তি বলে। তারা মনে করেন হাওর এলাকার মানুষের অন্ন যোগান বোরো ধান যাতে সুষ্ঠভাবে ঘরে তুলতে পারে এর জন্যও পূজার আয়োজন করেন তারা। মনোবাসনা পূর্ন সহ অনেক আশা-আখাঙ্কা পুর্ণ করতে দুর দরান্ত থেকে সনাতন ধর্মের লোকজন ছুটে আসেন চড়ক পূজায়া।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রীকান্ত তালুকদার জানান, এই পূজায় হিন্দু-মুসলীম দুই ধর্মের হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলায় সম্প্রীতির বন্ধনে পরিণত হয়। আর আমাদের বিশ্বাসমতে হাওরের ধান সুষ্ঠভাবে গোলায় উঠার আশা রাখি। এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আদি লোকসংস্কৃতি। এই ঐতিহ্য আমাদের প্রজন্ম লালন করবে বলে প্রত্যাশা রাখি।
ছয়হারা গ্রামের বাসিন্দা ও ফেনারবাঁক ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চন্দ্র তালুকদার বলেন, প্রায় দেড়শ বছর ধরে আমাদের গ্রামে চড়কপূঁজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই লোকউৎসব আমাদের একটি ঐতিহ্য। গ্রামবাসী এই লোকউৎসব চড়কপূঁজার আয়োজন করে থাকেন। এতে বিভিন্ন এলাকার মানুষজন জড়ো হন। পুঁজাকে কেন্দ্র করে এলাকায় আনন্দ মুখর পরিবেশ জমে ওঠে।
##
মন্তব্য করুন