বর্তমান সরকারের আমলানির্ভরতা


দ্যা সিলেট পোস্ট প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৩, ২০২১, ১১:৫৩ অপরাহ্ন /
বর্তমান সরকারের আমলানির্ভরতা

মাহবুবুল আলম

আমলাদের বাড়াবাড়ি ও বেপরোয়া আচরণে আওয়ামীলীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা আজ চরম ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। অনেক আমলার বাড়াবাড়ি এবং ক্ষমতার দাপটে সরকারি দলের নেতা কর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্দ করে তোলছে। তারা নানান ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের গায়ে এর দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা এখন এতটাই বেপড়োয়া যে তাদের কাছে সাধারণ মানুষ দূরে থাক, তারা সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধি এবং দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকেও পাত্তা দিচ্ছে না। বরং পারলে তাদেরকে নানাভাবে হেনস্তা করছে। তাদের কাছে আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিগণিত হচ্ছে।

যাক এখন আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই ২০১৮ সালের আওয়ামিলীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদেও আমলাদের এতটা বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়নি। কিন্তু আওয়ামীলীগ চতুর্থবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই
সরকারি দলটির ওপর আমলারা যেন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। তাদের অনেকেই এখন একথা বলে বেড়াচ্ছে যে, ২০১৮ সালে তাদের কারণেই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তাই সরকার ইচ্ছা করলেও তাদের প্রতি কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে একবার নয় সাতবার ভাবতে হবে। বরং আমলারা সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকারই পড়ে যাবে।

এমন কথাও এখন বলাবলি হচ্ছে, তাদের কারণেই আওয়ামী লীগের সিনিয়র অনেক নেতা সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কেননা, ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতাদের তাদের পছন্দ নয়। দলের সিনিয়র নেতারা মন্ত্রীসভায় থাকলে আমলারা কখনো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতেই রাজনীতিবিদদের তারা কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন।

ইদানিং দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমলাদের সাথে জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। দেশের অনেক স্থানে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) শুনতে চাইছেন না মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের কথা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করছেন এটা কোন ভাল লক্ষন নয়। কোভিড-১৯ মহামারীর পর করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমলারাই প্রভাব বিস্তার করছেন বলে মনে হচ্ছে। সংসদ তথা স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরকে যেভাবে রিলিফ ও অন্যান্য কাজে যতটুকু সম্পৃক্ত করার কথা ততটুকু সম্পৃক্ত করা হয়নি। সচিবালয় থেকে জেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন থেকে উপজেলা প্রশাসনকে সব কাজ করতে দেখা গেছে।

দীঘদিন থেকেই আমলাদের সাথে জনপ্রতিনিধিদের এক ধরণের ঠান্ডা লড়াই চলছে। আগে সেটি তেমন দৃশ্যমান না হলেও দিনে দিনে তা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী আমলাতন্ত্রের ওপরই ভরসা রেখেছেন বেশি, সে সামরিক-বেসামরিক যা ই হোক। রাজনৈতিক দল, এমপি এখানে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ কি না, বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে তা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিলেন। তাঁর ওই পদক্ষেপ সম্পর্কে রাজনৈতিক বিরোধিতা-বিতর্ক আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন কীভাবে আমলাতন্ত্র তাঁকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দেশ গড়ার তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল।

যুগে যুগে আমলাতন্ত্র ছিল এবং থাকবেও। কিন্তু আমলাতন্ত্র যখন রাষ্ট্রীয় নীতি নিধারণ থেকে সব ক্ষমতাই কুক্ষিগত করে ফেলতে চান তখনই ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারসাম্য ঠিকে থাকে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের সাথে শুরু হয় দ্বন্ধ। আর এই দ্বন্ধকে কেন্দ্র করে সরকারি কাজে শুরু হয় স্থবিরতা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার অভাবেই এ দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়ে থাকে।

প্রিয় পাঠক আসুন এ পর্যায়ে আমলাতন্ত্র কী এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। আমলাতন্ত্র ( Bureaucracy) এমন এক শাসনব্যবস্থা যাতে স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে সরকারের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। আমলারা জনপ্রতিনিধি নয় বা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নয়। ফলে রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তিত হলেও আমলারা পদ হারায় না। এই চারিত্র্যের কারণে আমলাতন্ত্রে সরকার পরিচালনার ধারাবাহিকতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়।
আমলাতন্ত্রের আভিধানিক সজ্ঞার্থ হলো: আমলা হচ্ছেন সরকারের অংশ যারা অনির্বাচিত। আমলাদের নীতিনির্ধারণ তৈরিকারক হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে, আমলারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। যারা জনগণের ভোট দ্বারা নির্বাচিত নন। বর্তমান সময়ে, আমলাদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বড় একটি অংশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রশাসন সম্পর্কে একটি অভিযোগ যে, আমলাতন্ত্রের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার প্রশাসন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। বিভিন্ন গবেষনায় ওঠে এসেছে যে, প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত কোন সময়ই দক্ষিণ এশিয়ার আমলাতন্ত্র রাজনীতি মুক্ত ছিল না। উপনিবেশ পূর্ব রাষ্ট্রকাঠামোতে আমলাতন্ত্র ছিল রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আর উপনিবেশিক কাঠামোয় তারা নিজেরাই ছিলেন শাসক। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯১৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত Indigenous Politicians-দের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হতো Political Bureaucrats দ্বারা। তাদেরকে বলা হতো Steel frame of Bureaucracy. তবে তারা অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু কালক্রমে সেই Steel frame of Bureaucracy এখন Partisan Bureaucracy তে রূপান্তরিত হয়েছে।

আমলারা সরকারের স্থায়ী কর্মচারি। তাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো, যেসব রাজনীতিক সরকারি কাজে নিযুক্ত তাদের সরকারি নীতিমালা সম্বন্ধে অবহিত করা, পরামর্শ দেয়া এবং সরকারি নীতি ও নির্দেশনা অনুসারে কাজ বাস্তবায়ন করা। তারা তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দায়ী। তবে শেষ বিচার তিনিই দেখবেন কোথাও আইনের ব্যত্যয় ঘটছে কিনা। আমাদের শাসনতন্ত্র ব্রিটিশদের থেকে যে শাসনব্যবস্থা গ্রহণ ও আত্মস্থ করেছে, তা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের অফিসারদের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব শাসনব্যবস্থায় তারা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন, নির্বাচিত সরকার ও তার মন্ত্রীদের জননেতা হতে দক্ষ প্রশাসকে পরিণত করার প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনীয় তদারকিও তারাই করেন। শাসন পরিচালনার জটিল, বহুমুখী ও বহুমাত্রিক বিষয়গুলো নেতা-মন্ত্রীদের গোচরে আনা, তাদের সে সব বুঝানো এবং হাতে ধরে শেখানোর কাজও এদেরই। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে দেখছি এরা হয়ে উঠছে মন্ত্রী আর এমপিদের তাবেদার।

বর্তমানে সচিবালয় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত আমলাতন্ত্রের দাপটে প্রশাসনে চরম হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেক সচিবই মন্ত্রীদের গুরুত্ব দেন না। সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মতো করে। এতে উপেক্ষিত মন্ত্রী দুঃখ করেন রাজনৈতিক মহলে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো মাঠ পর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করেন না। কেউ কেউ অতি উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। অনেক কর্মকর্তাই নিজের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে ব্যস্ত। তারা বর্তমান পরিচয় দিতে চান না। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনীতিবিদদের মতো করে। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে এর ডালপালা আরও ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। এতে সরকারের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের আজকের এ অবস্থার জন্য রাজনৈতিক নেতারাই অনেকাংশে দায়ী। আমলাদের এমন দাপুটে অবস্থার কারণে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু আমলাতন্ত্রেই যে এ অবস্থা তা নয়, সাবেক আমলারা মনে করেন, পুলিশ প্রশাসনেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মাঠ প্রশাসনে এবং মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। সম্পর্ক শীতল হচ্ছে। কোথাও কোথাও ঠান্ডা যুদ্ধও হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করাচ্ছেন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা। মন্ত্রী-এমপিদের মতো, উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দূরত্ব বাড়ছে স্থানীয় প্রশাসনের। ইউএনওরা সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ না করায় উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে আছে। গত সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই এমন পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ পরিস্থিতি এখনই সামাল দিতে না পারলে ভবিষ্যতে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব আরও বৃহৎ আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের বিরোধ যে তুঙ্গে উঠেছে সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় তা পরিষ্কার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদারের মতে, ‘‘১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতক ক্ষমতা রাজনীতির বাইরে নেয়া হয়৷ অন্যদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়৷ তারপর সেই ধারবাহিকতায় সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন হয় সেখানে নতুন আরেকটি বিষয় দেখা যায়৷ রাজনীতিতে নতুন কিছু লোকের আবির্ভাব হয়৷ তারা হলেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক আমলা এবং বড় কিছু ব্যবসায়ী৷ এখন আমাদের দেখা দরকার যাদের আমরা রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা দেখছি তাদের কতজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দক্ষ৷ তাই দক্ষতার এ প্রশ্নে আমরা চাই বা না চাই রাজনৈতিক ক্ষমতা আমলাতন্ত্রের হাতে চলে যাচ্ছে৷”

শেষ করতে চাই এই বলেই যে, আমলাতন্ত্রের চরিত্র ও মূল্যবোধে গণতান্ত্রিক রূপান্তর না ঘটাতে পারলে উন্নয়ন আর গণতন্ত্র দুটোই একসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। কাজেই গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমলাতন্ত্রকে প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতর রাখতে না পারলে গণতন্ত্র কখনো শক্তিশালী হবে না, এর খেসারত অতীতে যেমন দিতে হয়েছে, আগামীতেও দিতে হবে জনগণকেই। অতএব সাধু সাবধান।

লেখকঃ কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক