মাহবুবুল আলম
অসাম্প্রদায়িক বাঙালির প্রাণের উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালিরা পৃথিবীর যে যে প্রান্তেই থাকুক এ দিনকে ঘিরে সবাই উৎসবের আনন্দে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। নতুন করে আমাদের বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। প্রত্যাশা জাগায় নতুন বছরে, যত অপশক্তি ধ্বংস করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
এদিনটিকে তাই এখন আর কেবল উৎসবের দিন হিসেবেই বিবেচনা বা গন্য করা হয় না; এ দিনটি এখন আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আমাদের জীবনে আবির্ভূত হয়েছে। তাই হয়তো কবি বলেছেন,‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি, এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশী।’
বর্ষবরণের ক্ষণগণনা শেষে রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। তাই পহেলা বৈশাখ ঘিরে বাংলার প্রতিটি ঘরে বেজে ওঠেছে নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার সুরধ্বনী ‘এসো হে বৈশাখ। এসো এসো! বাতাসে কান পাতলেই আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কন্ঠে কন্ঠে শোনা যায় জীর্ণ-পুরাতন-ব্যর্থতা আর গ্লানি ভুলে যাওয়ার গান।
ইংরেজ জাতির খ্রিস্টীয় সাল আছে এবং সেই অনুসারে তাদের পয়লা জানুয়ারি ও নিউ ইয়ার্স ডে পালিত হয়। আরব জাতির হিজরি সন আছে এবং সেই অনুসারে তাদের পয়লা বছর ও নওরোজ আছে। নতুন বছরকে বরণ করার রেওয়াজ সর্বত্রই চালু রয়েছে। পাশ্চাত্যে খ্রিস্টান জগতে পয়লা জানুয়ারি পালিত হয় নববর্ষ। বর্তমানে পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ পালন অনেকটা সর্বজনীন হয়ে উঠেছে শুধু পাশ্চত্যেই নয় প্রাচ্যেও। সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানদের নববর্ষ মোহররমের আশুরা থেকে। যতটুকু জানা যায়, মক্কা মদিনা যখন পারস্যের প্রদেশ হিসেবে গণ্য তখন সেখানে পালিত হতো নববর্ষ। হজরত (সাঃ) মদিনায় হিজরতের দুবছর পর নওরোজ বাদ দিয়ে প্রবর্তন করেন ঈদ উৎসব। ইহুদিদের নববর্ষের নাম রাসহাসানা, ভিয়েতনামিদের নববর্ষকে বলা হয় তেত। আর বাঙালির আছে বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। আমরা পয়লা বৈশাখকে নববর্ষের দিন হিসেবে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদাযাপন করে থাকি।
বাংলা নববর্ষ পালনের মূলে আছে কৃষি। আগে বছর গণনার ভিত্তি ছিল চন্দ্রকলা। পরে ফসল বোনা ও কাটা বা কৃষির কারণে চন্দ্র, সূর্য বা চন্দ্রসৌর বছরভিত্তিক গণনা শুরু হয়। এনামুল হক লিখেছেন, গোড়ায় নববর্ষ ছিল মানুষের আর্তিব উৎসব বা ঋতুধর্মী অনুষ্ঠান। ঋতুধর্মী বলে কৃষির সঙ্গেও এর সম্বন্ধ ছিল অতিঘনিষ্ঠ। কারণ কৃষিকাজ একটি ঋতুনির্ভর মানববিজ্ঞান। প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার নয়ঋতুর পরিবর্তন থেকেই পালিত হতে থাকে নববর্ষ।
বাংলাপিডিয়ার তথ্যমত, ‘কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)।’ প্রধানত কৃষকদের খাজনাপাতি দেয়ার সুবিধার্থে এই সনের প্রবর্তন করা হয়। এ কারণে এই সনের আরেক নাম ‘ফসলি সন’। প্রথমে এটিই প্রচলিত ছিল, পরে এর পরিচিতি দাঁড়ায় বঙ্গাব্দ নামে, যা আজও কার্যকর রয়েছে। চন্দ্রের নিয়মে প্রচলিত হিজরী সন ও সৌর নিয়মে প্রচলিত বাংলা সনের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় মানুষের সুযোগ ও সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সনের প্রবর্তন করা হয়। বাঙালি জাতির জন্ম ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার সভ্যতা,সংস্কৃতির, লোকাচার, উৎসব, পার্বণ সবই কৃষিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলা সনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উৎসব আনন্দে মেতে ওঠার দিন। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় গণমুখী উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ সেজন্যই আমাদের আর্থ-সামাজিক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালির ঐতিহ্যের এক অনন্য অনুসঙ্গ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেকেও খ্রিস্টীয় সালের দিনক্ষণ মেনে চলতে হয়। তবুও বাঙালির ঐতিহ্যের শিকড়ে প্রোথিত বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের জাতীয় জীবনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই জীবন জন মানুষের জীবন। সংস্কৃতির এই মানুষ শ্রমনির্ভর, এই মানুষ উৎপাদক এবং সর্বোপরি মাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই বাঙালির সংস্কৃতির শেকড় জন মানুষের অন্তরে প্রোথিত বলেই নতুন বছর জাতির জীবনে নতুন সৌভাগ্য ও সম্ভাবনা বহন করে আনে।
আমাদের জীবনে বাংলা নববর্ষ আগামীর প্রত্যাশা নিয়ে দিনটিকে বর্ণাঢ্য ও উৎসবমুখর করে পালন করা হয়। তেমনি বাংলা নববর্ষ বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। এই ঐতিহ্য সচেতনতার কারণে পঞ্চাশের দশক থেকে ঢাকায় এবং সারা দেশে প্রভাতী সংগীতের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ পালনের আয়োজন শুরু হয়। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিলে, এর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে রমনায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে ছায়ানট। স্বাধীনতার পর এ আয়োজনই জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। এতে এক নব জাগরণের সৃষ্টিহয়। এই নবজাগরণের কালেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেশ কিছু সংগঠনের জন্ম হয় এবং এসব সংগঠন বাঙালি সংস্কৃতির নিবেদিত চর্চার মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে সহায়তা দান করে।
বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখের এই উৎসবকে সর্বজনীন উৎসব বলা হয় কারণ এ উৎসবে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ অংশগ্রহণ করে। বাঙালি জীবনের মৌলচেতনা হল অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা। আর পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ হলো
সেই মৌলচেতনার মোক্ষম ধারক ও বাহক।
বাঙালিরা সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বরণ করা হবে নতুন বাংলা বছর ১৪৩১। এবারের পহেলা বৈশাখের অন্যরকম আবহ। ঈদের ছুটির পরপরই পহেলা বৈশাখ। ঈদের আনন্দের পরপরই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আনন্দে মেতে উঠবে দেশবাসী। এমনটা এর আগে দেখা যায়নি খুব একটা দেখা যায়নি।
সবার আগামী দিনগুলো সুন্দর হোক, মঙ্গলময় হোক এই কামনা করে সবাইকে জানাই বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা!
১৩ এপ্রিল ২০২৪
ডেট্রয়েট, মিশিগান ইউএসএ
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
আপনার মতামত লিখুন :