কুমিল্লা কি শুধুই খুনি মোস্তাকের জন্মস্থান ||


দ্যা সিলেট পোস্ট প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২৪, ২০২১, ১১:৪১ অপরাহ্ন /
কুমিল্লা কি শুধুই খুনি মোস্তাকের জন্মস্থান ||

মাহবুবুল আলম

দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগ (পুরাতন ও নতুন) বৃহত্তর জেলার নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষের মানুষের দীর্ঘ দিনের ‘কুমিল্লা বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার দাবিটি এখন নামকরণের বেড়াজালে আটকে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কুমিল্লা বিভাগের নাম মেঘনা নামে হলেই তবে তা হবে, না হলে হবে না।

এনিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক ভিডিও কন্ফারেন্সে কুমিল্লার জননন্দিত সাংসদ বাহাউদ্দীন বাহার এর যুক্তি-তর্কের একটি ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায় সাংসদ বাহাউদ্দীন বাহার সাহেব কুমিল্লা নামেই কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যুক্তি-তর্কে লিপ্ত হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে বলেছেন, “কুমিল্লা বিভাগ হলে ‘মেঘনা’ নামেই হবে” এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার
বলেছেন ‘কু’ নিন্দাবাচক শব্দ দিয়ে কোনো বিভাগের নামকরণ করতে চান না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার নাটের গুরু খন্দকার মোস্তাকের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি যে কথাটি বলেছেন তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভ ও বেদনার বিষয়টি আমরা জানি। কুমিল্লার লক্ষ লক্ষ মানুষও ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার অধিবাসী হয়েও এই ঘৃণিত খুনির কারণে লজ্জিত। তাই একজন খুনির অপরাধের দায় কুমিল্লা জেলার
সাড়ে তেত্রিশ লক্ষ মানুষ কিছুই নিতে পারে না। তবে এটিকে কুমিল্লাবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ বলে একটি কুচক্রী মহল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষপিয়ে তোলতে ঘোলা পানিতে
মাছ শিকারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

যাক, জনৈক ফেসবুক ইউজার বলেছেন-“কু” শব্দের শুরুতে থাকলেই যদি খারাপ কিছুই হয়, তবে কুশল, কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রাম, কুমার, কুলীন – কুসুম, কুহুতান, কুহুরব, কুহুকণ্ঠ সহ অসংখ্য শব্দের তাহলে কি পরিবর্তন করতে হবে”? না তা হবে কেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো আবেগে কথাটি বলেছেন। তা ই যদি তাহলে তো তিন বৃহত্তর কুমিল্লার চার জন নেতাকে তাঁর ক্যাবিনেট পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দিতেন না। তা ছাড়া কুমিল্লায় তো কেবল খুনি মোস্তাকের বাড়িই নয়, এখানে রয়েছে আরো প্রায় সাড়ে তেত্রিশ লক্ষ মানুষের নিজেদের পরিচয় ও অস্তিত্বের ঠিকানা।

ঐতিহ্য, শিল্প সাহিত্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কুমিল্লার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- “কুমিল্লা প্রাচীনকালে সমতট জনপদের অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন খান ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতল অংশ সুবাহ বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ত্রিপুরা দখল করে। ১৭৬৯ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানী একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। তখন ঢাকা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল কুমিল্লা। কুমিল্লাকে ১৭৭৬ সালে কালেক্টরের অধীনস্থ করা হয়। ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি হয়, পরবর্তীতে সমতল অঞ্চল নিয়ে ত্রিপুরা ও পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে পার্বত্য ত্রিপুরা নামে ভাগ করা হয়, এই জেলার সদর দপ্তর স্থাপিত হয় কুমিল্লায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশ গঠিত হলে এই দুই অঞ্চল দুই দেশে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে সদর দপ্তরের নামানুসারে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা এবং তখন থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদটির নামকরণ জেলা প্রশাসক করা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার দু’টি মহকুমা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক জেলা হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়”। (তথ্য: উইকিপিডিয়া বিশ্ব শব্দকোষ)

আগে কুমিল্লাকে বলা হতো শিক্ষানগরী। কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড কুমিল্লা শহরে অবস্থিত। কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এই বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। আগে সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম বিভাগ কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ছিল। সাম্প্রতিককালে, আলাদাভাবে চট্টগ্রাম ও সিলেট শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয়েছে। বর্তমানে কুমিল্লায় শিক্ষার হার ৬০.০২% (২০১১ সালের শিক্ষা জরিপ)। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমবেশি ৬৫ ℅ এর মতো।

দেশের শিক্ষা বিস্তারে কুমিল্লার অবদান অনেক। এখানে গড়ে উঠেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আর্মি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, ময়নামতি মেডিকেল কলেজ, আর্মি মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজসহ রয়েছে আরো অনেক সরকারী বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লা প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে এ উপমহাদেশে সুপরিচিত। রসমালাই নামক বিখ্যাত মিষ্টি কুমিল্লায় তৈরি করা হয়। কুমিল্লার রসমলাই সারাদেশে এক নামে পরিচিত। দুধ, ছানা ও চিনি সমন্বয়ে তৈরি এ মিষ্টান্ন। যার প্রচলন কুমিল্লাতেই শুরু হয়। অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি প্রস্তুতের জন্যও কুমিল্লা বিখ্যাত। এছাড়াও কুমিল্লার বিখ্যাত খদ্দর (খাদি) শিল্পের জন্য। ১৯২১ সাল থেকে খদ্দর এ অঞ্চলে প্রচলিত। কুমিল্লার খদ্দর শিল্পগত উৎকর্ষে প্রচুর খ্যাতি লাভ করেছিল। এখান থেকে খদ্দর কাপড় কলকাতা ও বোম্বে পাঠানো হত। বাঁশের বাঁশির জন্য কুমিল্লা বিখ্যাত। কুমিল্লার হোমনার শ্রীমদ্দি গ্রাম উপমহাদেশের বাঁশের বাঁশির জন্য সুবিখ্যাত; শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশিপাড়ার বাঁশি বর্তমানে দেশ-বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে সগৌরবে। এছাড়াও তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প ও কারু শিল্প, ময়নামতির শীতল পাটি ইত্যাদি স্ব-স্ব ঐতিহ্যে স্বকীয়তা আজও বজায় রেখেছে। (তথ্যসূত্র : বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও নিউজ পোর্টাল)

তৎকালীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবি যে “ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত” উত্থাপন করেছিলেন তার বাড়ি এই কুমিল্লা। আমাদের অতি প্রিয় এই লাল-সবুজ পতাকার ডিজাইনার শিব নারায়ণ দাসের বাড়িও এই কুমিল্লায়। এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এনে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে কুমিল্লারই দুইজন সন্তান।

আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধেও কুমিল্লার অবদান অনস্বীকার্য। একমাত্র কুমিল্লা জেলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের দুইটি সেক্টর ছিলম কুমিল্লায়। সাহিত্যের অন্ততম শ্রেষ্ঠ-কবি “একাত্তরের ডায়রি”-এর রচিয়তা কবি সুফিয়া কামাল, বৃটিশ ভারতে একমাত্র নারী হিসেবে ” নওয়াব” খেতাবপ্রাপ্ত নওয়াব ফয়জুন্নেসা, কুমিল্লা সুর সম্রাট শচীন দেব বর্মণ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আখতার হামিদ খান, সংগীতশিল্পী লাকি আকন্দ, আসিফ আকবর, ক্রিকেটার ও আন্তর্জাতিক আম্পায়ার এনামুল হক মনিসহ আরো অনেক অনেক গুনীজন এই কুমিল্লার গর্বিত সন্তান।

আমরা দেখেছি সবকয়টা বিভাগ কোন না কোন জেলার নামে হয়েছে , কুমিল্লার নাম কেন নদীর নামে হবে? বিভাগীয় অঞ্চলের যে কয়টা জেলা থাকে তারমধ্যে যে জেলা সর্ব দিক বিবেচনায় যোগ্যহয় তার নামেই বিভাগ হওয়ার কথা। অন্যান্য বিভাগতো সে নিয়মেই হয়েছে। কুমিল্লার ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হবে কেন এ নিয়ে কুমিল্লাবাসী সবার মনেই প্রশ্ন রয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বাংলাদেশের স্থপতি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রমানের কন্যা। আপনার হৃদয়ও বঙ্গবন্ধু মতো কোমল এবং মানবিক। আপনি আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশকে সবদিক থেকেই
অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা তেমনি আপনিও আধুনিক উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একজন নিপুণ কারিগর তাই আপনার ওপর মানুষের ভরসাও অনেক বেশি। কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষও যে আপনার ওপর আস্থাশীল তা বিগত দিনের নির্বাচনে প্রমাণিত। আপনিই কুমিল্লাকে বিভাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন তাই কুমিল্লার মানুষের দীর্ঘ দিনের কুমিল্লা বিভাগের দাবি আপনার হাত ধরে বাস্তবায়িত হবে এবং আপনি কুমিল্লার মানুষের আবেগের সহানুভূতিশীল একথাটা আমরা বিশ্বাস করি।

লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক