নজরুল ইসলাম ll
প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক বুঝি আর নেই। সোজা বাংলায়, কোনো কোনো মৃত্যু মানুষকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। কাছের মানুষ চলে যাওয়ার পর যে শূন্যতা চেপে ধরে তার ভার স্বাভাবিকভাবে বহন করার শক্তি কম মানুষেরই আছে। প্রয়াত পিতাকে হারিয়ে এমনটাই অনুভব করছি ।
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে বলেছিলেন, ‘তুঁহু মম শ্যাম সমান’। মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়। মানুষ মরণশীল হলেও সে কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করতে পারে। বেঁচে থাকার মানে জৈবিকভাবে বেঁচে থাকা নয়। সংক্ষিপ্ত মানবজীবনকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে হলে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতে হলে কল্যাণকর কর্মের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ইসহাক কাজল ছিলেন তেমনি একজন।
মৃত্যু অনিবার্য, এটি চিরন্তন সত্য। তবুও মানুষ তাঁর সৎকর্মের মাধ্যমে চিরকাল স্বরণীয় হয়ে থাকতে পারে। সেজন্য যাঁরা কীর্তিমান তাঁরা তাঁদের সেবামুলক কাজের মাধ্যমে মানবসমাজে বেঁচে থাকেন বহু যুগ ধরে। এ পৃথিবীতে সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কোনো মানুষই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না। সেজন্য দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা বড় কথা নয়, কারণ এতে তার অমরত্ব আসে না। মানুষ অমরত্ব পায় তার কর্মের মাধ্যমে। কর্ম তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে সাধারণ মানুষের অন্তরে চিরদিন। অর্থাৎ, যেসব মানুষ নিঃস্বার্থভাবে পরোপকারে আত্মনিয়োগ করেন, মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে বিলিয়ে দেন- মৃত্যুর পরেও তাঁরা অমর হয়ে থাকেন মানুষের মাঝে। এভাবে কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব তাঁদের সৎ কর্মের জন্য অমরত্ব প্রাপ্ত হন। এসব লোকের দৈহিক মৃত্যু হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অমর। সর্বদাই তাঁরা মানবের অন্তরে বিরাজ করেন। মানুষ তাঁদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আমাদের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ইসহাক কাজল ছিলেন তেমনি একজন।
মানুষের দেহ নশ্বর, কীর্তি অবিনশ্বর। কেউ যদি মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করে, তবে মৃত্যুর পরেও তাঁর কীর্তির মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি চিরকাল বেঁচে থাকেন। আমাদের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ইসহাক কাজল তেমনি একজন স্বাধীনচেতা স্বতন্ত্র গুনে গুনান্বিত মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
ইসহাক কাজল সবাইকে নিয়েই কাজ করতেন। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতেন। বিশাল একটা মন ছিল তিনির। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র ভিন্ন, প্রায়ই মনে হয় মানুষের মধ্যে সংকীর্ণতা হিনোমন্যতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমরা সবাই মিলে এক সাথে জড়ো হয়ে মন খুলে কারো জন্য দোয়া করতে পারি না। কাউকে স্বরন করতে হলে, কারো জন্য দোয়া করতে হলে আজ কাল আমরা সার্বজনীন করতে পারি না। আমাদের সমাজের তথাকথিত সমাজ সংস্কারকরা মনে করেন অনুস্টান বড় হলে আমার নেতৃত্ব চলে যেতে পারে, যদি আমি সভাপতিত্ব করতে না পারি! এই বিযয় গুলো বড়ই আপত্তিকর, অনভিপ্রেত। বলেনতো এত হীন মনমানোসিকতা নিয়ে কেমন করে আমরা অমর হবো?
আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রয়াত ইসহাক কাজল ছিলেন সাংবাদিক, লেখক, রাজনীতিবিদ, প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি প্রবাসী লেখক পুরস্কারে ভূষিত। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এখনো মেনে নিতে পারছি না, তিনি ইসহাক কাজল আমাদের মাঝে আর নেই। মেনে নিতে হয়, এটাই নিয়ম। মারা যাবার দু-দিন পূর্বে দেখা করতে (Queen’s Hospital, Romford London) কুইন হাসপাতালে গিয়েছিলাম। এটাই ছিল তিনির সাথে আমার শেয দেখা। মনে পড়ছে আমাকে বলেছিলেন কিতা বা নেতা! বললাম, স্যার আপনে কেমন আছেন? আমাকে দেখে হাসপাতালে বেড থেকে পা নামিয়ে বসতে চাইলেন, ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার এলাকার সামগ্রিক বিযয় নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। আমাকে বললেন, “এই, তোমার লেখা পড়েছি, আমার মেয়েদের ও দেখাইছি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”কিতা করতায় আর লেখিয়া, বাছতাম নায়! স্বল্প সময়ে অনেক বিযয়ের অবতারনা করেছিলেন সেই দিন।
তিনির মেয়ে এ্যানি আপা এসে যোগ হলেন আমাদের সাথে। একটু পরে যোগ দিলেন প্রিয় আব্দুল মোতালিব লিটন। লিটন ও আমার সাথে যেভাবে কথা বলা শুরু করলেন তখন একটি বারও ভাবিনি দু-দিন পর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
আমাদের এলাকায় সদ্য প্রতিস্টিত নতুন স্কুলের ফটো দেখলেন। স্কুলের নাম জানতে চাইলেন। বললাম “আব্দুন নুর নুরজাহান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়। নাম শুনে বললেন, মানুযের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ এখনো আছে। বললেন, তোমার বাবাকে বলিও আমার জন্য দোয়া করার জন্য। বললেন, আমরা অনেক কিছুর স্বাক্ষী।
কমরেড সিকান্দর আলীর সাথে বাংলাদেশে ফোন সংযোগ করে দিলাম- hello বলেই বললেন কিতা বা নেতা- পাশে বসে ফনালাপ শুনলাম। ইসহাক কাজল সত্যি অনেক বড় মনের মানুয ছিলেন। বিস্বাস করতে কস্ট হচ্ছে তিনি আমাদের মাঝে আর নেই।
ইসহাক কাজল ছিলেন আমার বাবার ক্লাসমিট ও বন্দু। শ্রদ্ধা ভালবাসায় মাথা নিচ হয়ে যেত তিনির তরে। আমাদের সাথে তিনির কথা বার্তা চাল চলন বলন ছিল অনেকটা বন্ধুত্ব সুলভ। সেই দিন আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছে তিনির পা আমার লাপ (হাটুর) উপরে রেখে কিছু সময় হাত বুলায়ে দেবার। যে দিন মারা গেলেন অফিসে ছিলাম। তিনির মৃত্য খবর শুনার পর কেন যেন বুকটা ভারি হয়ে গিয়েছিল। এক এক করে সকল ভাল মানুযেরা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। অন্যায় অনিয়ম নিয়ে কে কথা বলবে ?
প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে মৃত্যু একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য। এ পৃথিবী অত্যন্ত মধুময় ও আকর্ষণীয় বলে মনে হয় কিন্তু আসলেই তা ছলনায় পরিপূর্ণ। অল্প ক’দিনের এ দুনিয়ায় আমরা মেহমান মাত্র। তাই আমাদের উচিত হবে মৃত্যুর কথা স্মরণ করে বেশি বেশি পুণ্যের কাজ করা।
পরিশেষে, প্রয়াত পরম শ্রদ্ধেয় ইসহাক কাজলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।
লেখক: জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।
মন্তব্য করুন