ডেস্ক রিপোর্ট। দি সিলেট পোস্ট।
আজ ১ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ১০৪তম জন্ম বার্ষিকী। আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি তাকে। এ কারণেই হয়তো রুডিয়ার্ড কিপলিং লিখেছিলেন-
‘God and soldier all men adore,
In times of danger and not before..
When danger is over and things are righted,
God is forgotten and poor soldier is slighted.’
জেনারেল ওসমানীর ৬৬ বছরের (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮-১৬ ফেব্র“য়ারি ১৯৮৪) জীবনটি ছিল এক মহাসাগরের মতো, যার ওপর দিনের পর দিন আলোচনা বা লেখালেখি করলেও শেষ করা যাবে না। সামরিক বাহিনীতে অনেকেই জেনারেল হন, কিন্তু মিলিটারি লিডার হতে পারেন না।
যে কোনো দেশের সামরিক বাহিনীতে জেনারেলরাই নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকেন। এমন সফল জেনারেল যুগে যুগে, দেশে দেশে ও বিভিন্ন জাতিতে ছিলেন বলেই সেসব দেশ ও জাতি বিশ্ব মাঝে মাথা উঁচু করে টিকে আছে।
যেমন-খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাশেম, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, বৈরাম খাঁ, মানসিংহ, জেনারেল আইসেন হাওয়ার, ফিল্ড মার্শাল আরভিন রোমেল, জেনারেল হ্যান্স গুদেরিয়ান, জেনারেল দ্য গল, ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম যোসেফ স্লিম, ইরানি জেনারেল কাশেম সুলায়মানী প্রমুখ।
আমরাও গর্ব করে বলতে পারি, আমাদেরও এমন একজন জেনারেল আছেন, যিনি বাংলাদেশ ও বিশ্বের যুদ্ধাতিহাসকে আলোকিত করেছেন এবং নিজ দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
একটি পরাধীন দেশকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে হলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করার জন্য উঁচুমানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনিভাবে দখলদার আগ্রাসী বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সামরিক বাহিনী ও এর নেতৃত্ব প্রদানের জন্য অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও দুর্ধর্ষ সামরিক নেতার। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগ্রত করার জন্য আমাদের ছিলেন কিংবদন্তির মহানায়ক, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অসাধারণ নেতা সিংহপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; আর সামরিক নেতৃত্বের জন্য ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ক্ষণজন্মা পুরুষ জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, যিনি তার অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, বাস্তবসম্মত কার্যকরী সমরকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তুলনামূলক বহুগুণে শক্তিশালী শত্র“বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ফলাফলকে অনুক‚লে নিয়ে আসেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, প্রথম সেনাপ্রধান, প্রথম জেনারেল, বিশ্বের চার-চারটি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন জেনারেল ওসমানী। তিনিই একমাত্র সামরিক অফিসার যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৭ সালে অবসরগ্রহণ করার ৪ বছর ১ মাস ২৪ দিন পর আবার সামরিক পোশাক পরিধান করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে নেতৃত্ব দেন।
সামরিক পোশাক ছাড়ার চার বছর পর জেনারেল ওসমানী মাতৃভ‚মির চরম সংকটময় মুহূর্তে আবার তা পরিধান করে বাংলাদেশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, যা বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। একবার চিন্তা করে দেখুন, সে সময়ে যদি ওসমানীর মতো তীক্ষ্ণ মেধাবী, দক্ষ, বিচক্ষণ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও সর্বজনগ্রাহ্য সিনিয়র সামরিক নেতা দৃশ্যপটে না আসতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এ যুদ্ধের কী অবস্থা হতো! জেনারেল ওসমানী তার বলিষ্ঠ, সুদক্ষ নেতৃত্বে ও যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংগঠিত করে দিকনির্দেশনা, অনুপ্রেরণা ও পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে শত্র“মুক্ত করে বহুলপ্রত্যাশিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অনন্য অবদান।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানী তার সারাটা জীবন কাটিয়েছেন এদেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য, উন্নতির জন্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসর্গ করেছেন তার জীবন-যৌবন, সহায়-সম্পত্তিসহ সবকিছু। অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্য তিনি সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং এক্ষেত্রে সফলতাও অর্জন করেছেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার পথকে উন্মুক্ত করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর একে একে এ রেজিমেন্ট সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছু হটেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, অস্ত্রমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যতদিন টিকে থাকবে, বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী বেঁচে থাকবেন এদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে।
কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি : সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন