রফিকুল ইসলাম জসিম, নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ইসলামের ভারত বিজয়ের পূর্বেই দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে আরব বণিক সম্প্রদায়ের ভারতে আগমনের সূত্র ধরে ভারতবাসী ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন। আরব ও উপমহাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবশ্য আরবে ইসলামের প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বজায় ছিল। সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে আরব মুসলমানরা প্রথম ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আরব জাতি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এরপর আরব বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিশ্বের সর্বত্র তাদের নতুন ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
১৬০৬ সালে সংঘটিত মুসলমান মণিপুরি যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ব্যাপক হারে মণিপুরে আগমনের অনেক পূর্বেই আরবের মুসলিমরা মণিপুরে পদার্পণ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন৷ মণিপুরের রক্ষিত বংশানুক্রমিক রাজকীয় ইতিহাসলিপি `পুয়া`বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বলে দাবী করেন মণিপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মোঃ ফারক আহমেদ তার লিখিত ইতিহাসের বই মণিপুরি মুসলিম বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ৬১৫ খ্রি. একজন আরব সাধক সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তার কিছু সংখ্যক সঙ্গীসহ মণিপুরে আগমন করেন৷ তিনি সম্পর্কে নবী মোহাম্মদ (স) এর মামা ছিলেন৷ সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হজরত মুহাম্মদ (স.) এর নির্দেশ আবিসিনিয়া হিযরত করেছিলেন৷
তিনি এভাবেও উল্লেখ করেছেন, ৬১৫ খ্রি. আবিসিনিয়া হতে এক মুসলমান প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীনে গমনে উদ্দেশ্য সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম আসেন৷ সেখান থেকে সিল্ক রোড ধরে অর্থাৎ চট্টগ্রাম -কামরুপ (আসাম) হয়ে মণিপুরে প্রবেশ করেন৷ মণিপুরে কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি ইউনান হয়ে চীনে গমন করেন৷ চীনে বেশ কিছুদিন থাকার পর তিনি একই পথ দিয়ে জন্মভূমি ফিরে যান৷ এই সাধকের মণিপুর সফরের সময় এক বা একাধিক আরবিরা মণিপুরে থেকে যান৷
ডা. ফারুক আহমেদ আরোও লিখেছেন খলিফা হয়রত আলী (রাঃ) এর দ্বিতীয় স্ত্রী খাওলা বিনতে জাফর এর ঔরসে জন্ম নেওয়া দুই সন্তানের জ্যেষ্ঠ সন্তান মোহাম্মদ হানিফা খিলাফতের আন্দোলনের ব্যর্থ হওয়ার পর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে আরাকানে আছেন এবং সেখানে একটি ইসলামিসমাজ তৈরি করে বসবাস শুরু করেন৷ তিনি দাবী করেন, মোহাম্মদ হানিফা একবার আরকান হতে মণিপুরে সফর করেছিলেন এবং সেখানে বসবাসরত স্থানীয় মুসলমানদের দেখা করেছিল৷ তাছাড়াও তৎকালীন সময়ে আরব ও পারস্যের মুসলমান বণিকরা সিল্ক রোড ব্যবহার করে চীনে বানিজ্যিক সফর করতেন এবং তখন মণিপুরই ছিল তাদের পান্থপথ। এভাবে মুসলমান সাধক ও বণিকদের মণিপুরে আসা যাওয়ার মধ্যেই এক বা একাধিক আরব মণিপুরে থেকে যায় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে৷ মণিপুরে দৃশ্যমান আরিবাম সাগৈ (বংশ) এর লোকেরা এই থেকে যাওয়া আরবদের বংশধর বলে মোঃ ফারুক দাবি করেছেন৷ তিনি আরো লিখেছেন আরিবম শব্দটি আরবি আরিবাহ শব্দ হতে এসেছে, যার অর্থ খাঁটি আরব৷
‘ওতলুবুুল ইলমা ওয়ালাও কানা বিস চীন’। কথাটি হাদিস বলে খ্যাত। যার অর্থ- তোমরা জ্ঞান লাভ করো, যদি তা চীন দেশেও থেকে থাকে। জাগতিক জ্ঞানবিজ্ঞানে সেকালে চীন খুবই বিখ্যাত ছিল। অনুমান করা হয়, এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্ব প্রথম চীন দেশের সম্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য একজন সাহাবীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ওই সাহাবীর নাম ছিল ওহাব ইবনে আবি কাবশা (রা.)। এটি ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের কথা। এরও বহু আগে ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হাবশায় হিজরতকারী একটি সাহাবী দল ইসলাম প্রচার ও ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে চীন পর্যন্ত যান। তাদের নেতার নাম ছিল সাহাবী আবু ওক্কাস মালিক ইবনে ওহাইব (রা.) তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মামা ছিলেন। তিনি সা’দ বিন আবু ওক্কাসের পিতা আবু ওক্কাস।
এখানে বলে রাখা ভালো চীনে যাওয়া প্রতিনিধিদলটির নেতা সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ছিলেন বলে ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়। এ কারণে চীনের ‘কানতুন’ শহরে তার নামে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যার বর্তমান নাম ‘রওজা আবি ওয়াক্কাস’। এই মসজিদের পাশে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের কবর রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই বর্ণনাটির সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৫৫ বছর বয়সে মদীনার কাছাকাছি আকিক অঞ্চলে নিজের প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন এবং বাকি’ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। কাজেই, যে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে পাঠানো সাহাবী পত্রবাহক সাহাবীদের অন্যতম। আর ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চীনে গমনকারী সাহাবী আবু ওক্কাস মালিক ইবনে ওহাইব ভিন্ন ব্যক্তি। যার পুত্র সা’দ ইবনে আবু ওক্কাস (রা.)। অধিক প্রমাণিত সূত্রে ক্যান্টনে যে সাহাবীদের কবর পাওয়া যায়, তারা পত্রবাহক নন। কারণ পত্রবাহক সাহাবী নবীজীর ইন্তেকালের পর মদিনায় ফিরে গিয়েছিলেন। ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে আগত সাহাবীদলের কবরই ক্যান্টনে হয়ে থাকবে। যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) পূর্বে ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চীনে এসেছিলেন।
ইতিহাসবিদদের মধ্যে মণিপুরে ইসলামের সূচনা এবং পাঙ্গাল নামের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক বর্ননায় খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে কিছু আরবীয় মুসলমান মণিপুরে পর্দাপন করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন৷ আবার কোনো কোনো সূত্রে সূচনা ৯৩০ সালের আগে-পরে বলে মনে করেন। তবে এর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারাটি মণিপুরে ১৬০৬ সালে বর্তমান বাংলাদেশের হবিগঞ্জের তখনকার সময়ে বৃহত্তর বাংলার তরফ অঞ্চল থেকে ঐতিহাসিক বিভিন্ন বর্ননায় এসেছে বলে নিশ্চিত করেন।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ভারতের মণিপুর রাজ্যের প্রভাবশালী রাজা খাগেম্বার (১৫৯৭-১৬৫২) আমলে ১৬০৬ সালে মুসলমানদের এক বড় বাহিনীর মণিপুরে আগমন হয়৷ মণিপুরি মুসলমানদের ইতিহাস সংবলিত পান্ডুলিপি নোংসামৈ গ্রন্থে উল্লেখ করেছে এ সেনাবাহিনীকে তরফ রাজ্যে সংগঠিত করা হয়। সেনাবাহিনীর পরিচালনা জন্য ১৬ জন সেনাধ্যক্ষের নাম উল্লেখ করা হয়৷ আরো উল্লেখ করেন ঐ বাহিনীর সেনাপতির নাম মোহাম্মদ শানী।
মন্তব্য করুন