মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী
যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে আশা-আকাঙ্খা দীর্ঘ ৫৪ বছরেও পূরণ না হওয়াটা চরম ব্যর্থতা। এই ৫৪ বছরে টেকসই জাতীয় ঐক্য না হওয়া তথা অনৈক্য এবং দুর্নীতি, এই দুটি বিষয় চরম ব্যর্থতার মূল কারণ। জাতীয় ঐক্যে বাধা সৃষ্টি ও দুর্নীতি আমরা দেশের জনগণই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে করে আসছি। অনেকে এর সাথে জড়িত না থাকলেও অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে উভয়ে যেরকম অপরাধী তদ্রূপ ব্যর্থতার নেতৃত্বদানকারী ও ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনকারীরা তথা দেশবাসীও ব্যর্থতার জন্য দায়ী।
ব্যর্থতার দায় এড়াতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে এবার আমরা দেশবাসীর ভুল করা চলবে না। এবার আমরা দেশবাসী এমন নেতৃত্ব নির্বাচন করবো, যে নেতৃত্ব টেকসই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার পাশাপাশি ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ে বিশ্বের জন্য বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করবে। দেশে সংখ্যালঘুদের আন্তরিক ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা গেলে সেটার প্রভাব ইন্ডিয়ায় পড়ে ইন্ডিয়ার সংখ্যালঘুদের বাঁচাতে অসাম্প্রদায়িক হিন্দুরা কার্যকরভাবে সংগঠিত হয়ে তাদের দেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে পরিণত করতে উদ্যোগ নেবে। বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়াতে প্রকৃত শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত হলে উভয় দেশ জ্যামিতিক হারে এগিয়ে যাবে।
৫৪ বছরের ব্যর্থতার জন্য সামগ্রিকভাবে আমরা পুরো দেশবাসী দায়ী হলেও মূল দায়ী ক্ষমতায় থাকা কর্তাব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দায়ী দেশের প্রধান নির্বাহী। মস্তিষ্ক, নিউক্লিয়াস তথা কেন্দ্র শতভাগ ঠিক হয়ে অন্যদের ঠিক করার যোগ্যতা দেখাতে না পারলে কাঙ্খিত সফলতা সম্ভব নয়। তাই এরকম অযোগ্য ব্যক্তির প্রধান নির্বাহীর পদে থাকার কোনো অধিকার নেই। অধিকার না থাকা সত্ত্বেও সমস্যার অংশ হিসেবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়াটা লোলুপতা ও দেশের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা।
দেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে গড়ে উঠা কোনো দল ক্ষমতায় গেলে বেশী কিংবা কম দলপ্রীতি করতে বাধ্য। তাই দলপ্রীতি তথা দুর্নীতি বন্ধে প্রচলিত পদ্ধতিতে গড়ে উঠা কোনো দলকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়া যাবেনা। বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি দেশে প্রচলিত ধারা তথা অপরাজনীতিমুক্ত থেকে কর্মকান্ড করে আসছে বিধায় দলটি ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব ও টেকসই জাতীয় ঐক্য উপহার দিতে পারবে। এই দলটিকে কিংবা এই দলের আদলে গড়া কোনো দলকে ক্ষমতায় পাঠানো না গেলে দেশকে কখনো দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না, টেকসই জাতীয় ঐক্যও হবে না। আর তাই জাতীয় ঐক্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি কিংবা তার আদলে গড়া কোনো দলকে নির্বাচিত করার কোনো বিকল্প নেই। এর বাইরে কোনো দলকে নির্বাচিত করে ক্ষমতায় পাঠানো হলে তাদের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার দায় ভোটদাতা দেশবাসীও এড়াতে পারবে না।
নিজস্ব দলের নেতা-কর্মীদের কথা চিন্তা করে পিছুটান, তাদের জন্য অনৈতিক সুপারিশ এসব কাজ গতানুগতিক সব দলই করে থাকে। বক্তব্য বিবৃতিতে রাষ্ট্রের সর্বজনীন কল্যাণের কথা বললেও গতানুগতিক সব দলই নিজের দলের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দলীয় প্রধান যখন সরকার প্রধান হবেন, তখন তিনি পুরো দেশেরই প্রধান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদেশের কোনো সরকার প্রধান দলের গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। দলের লোক অপরাধ করলে সাত খুন মাপের মতো রেহাই দেয়া হয় অন্যদিকে তেমন অপরাধ না করলেও অন্য দলের ব্যক্তির প্রতি স্টিমরোলার চালিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর এই পর্যন্ত কোনো সরকার প্রধান অন্যান্য দলের কাউকে নিজের বলে মনে করেনি। মনে করার কারণও নেই। কেননা সেসব দল সমৃদ্ধ হয়েছে, সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসের ভিত্তিতে। ক্ষমতায় গিয়ে সুবিধা না দিলে সরকার পতনে অন্যদের চেয়ে দলীয় লোকেরাই আগে ভূমিকা রাখবে। আগে থেকে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি মাইন্ডে ঢুকিয়ে দেওয়া না হলে তারা বিরোধিতা করতো না। দেশের সবাইকে নিজের মনে করতে না পারার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠা ব্যক্তিকে সরকার প্রধান বানালে সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।
তাই বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি শুরু থেকে বলে আসছে, দল ক্ষমতায় গেলে অন্যান্য দলের মতো দলীয় লোককে বাড়তি কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। কে ভোট দিয়েছে, কে ভোট দেয়নি – এরকম বাছ-বিচার না করে সবার প্রতি সমান ও ন্যায্য ব্যবহার করা হবে। দেশের সব দল ও মতের সবাই বাংলাদেশ ঐক্য পার্টির অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য কারো প্রতি আনুকূল্য কিংবা বিদ্বেষ দেখাবে না। অপরাধী নিজের দলের কিংবা নিজের পিতা কিংবা সন্তান হলেও ছাড় পাবে না।
সকল মতপার্থক্য অক্ষুন্ন রেখে সর্বজনীন বিষয়ে ঐক্য গড়ার জন্য শুরু থেকে প্রাপ্যতা বিবেচনায় দল ও ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে দলটি এগিয়ে যাচ্ছে। ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ থেকে দলটি বলে আসছে যে, মহাজোট ও বিশ দলীয় জোট দেশের বাকী ৮৫ ভাগ জনগণের ন্যায় বাংলাদেশ নামক মায়েরই সন্তান। সেই হিসেবে আমরা সকলে পরস্পর ভাই ভাই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সবারই অবদান রয়েছে। তাই বিভাজিত না হয়ে, কাউকে মাইনাস না করে সবার মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সমস্যা থেকে উদ্ধার করে শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করতে চায় বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি।
অপরাজনীতি প্রোডাক্ট নন, এমন ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও তিনি অপরাজনীতির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ায় জাতীয় ঐক্য ফাটল ধরে দুর্নীতি চলমান রয়েছে। টেকসই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড কিংবা অন্যান্য উন্নত দেশের ন্যায় দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের মোক্ষম সুযোগ ড. মুহাম্মদ ইউনূস পেলেও তিনি তা কাজে না লাগিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। সামনের নির্বাচন যদি তিনি সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হন, তাহলে হাসিনার আমলের চেয়েও দেশের খারাপ পরিণতি হবে। তখন দেশবাসী আজীবন ড. ইউনূসকে দায়ী করবেন অন্যদিকে দেশে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশকে তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে রুপান্তর করতে বদ্ধপরিকর যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে বিগত সময়ের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যর্থতা ভুলে গিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব দেশবাসীকে উপহার দেওয়ায় দেশবাসী আজীবন ড. ইউনুসকে বাহবা দিবে।
জাতীয় ঐক্য ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন দল ভোটের আগে যা কিছু বলুক না কেনো অন্তত তাদের নিজেদের দলের প্রথম সাত জনের মধ্যে শতভাগ সততা না থাকলে জাতীয় ঐক্য ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন সম্ভব হবে না।
জাতীয় ঐক্যের জন্য কোনো দলের কমপক্ষে প্রথম সাত জনের শতভাগ সততার আস্থাশীল ভাবমূর্তিসহ তিনশত আসনে জাতীয় ঐক্যের প্রার্থী ঘোষণা করা গেলে সেই দল ক্ষমতায় গেলে জাতীয় ঐক্য যে হবে, তা দেশবাসী বিশ্বাস করে অবশ্যই সেই দলকে ভোট দেবে। ভোট/নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার আনতে ড. ইউনূস ব্যর্থ হলে কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে আসবে না। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে প্রভাবমুক্ত শতভাগ স্বচ্ছ নির্বাচন ড. ইউনূস উপহার দিবেন-এমনটাই বাংলাদেশ ঐক্য পার্টির প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি নিবন্ধিত যেকোনো দলের মার্কা নিয়ে (…দল মনোনীত ও বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি সমর্থিত) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি একটি সাময়িক রাজনৈতিক দল এবং প্রথম ও শেষ বারের মতো একবারই নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ায় নিরংকুশ বিজয় অর্জনের সম্ভাবনা দেখা না দিলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ন্যায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিবে না।
উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা এবং যোগ্য প্রার্থী পাওয়া সাপেক্ষে বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি নির্বাচনের যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো যা ৪ নভেম্বর ২০২৩ দৈনিক নয়া দিগন্ত, ঢাকা মেইল, ঢাকা টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় আমরা সেই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করিনি। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ৯১ সালে নির্বাচনে জেতা সবগুলো দলের জন্য হিসাব করে জাতীয় ঐক্য যাতে বজায় থাকে তারজন্য আমাদের পক্ষ থেকে আওয়ামীলীগ ১০০, বিএনপি ১০০, জাতীয় পার্টি ৩৫, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ২৪, জামায়াত ১৮, বাম রাজনৈতিক দলগুলোর যারা ৯১ তে জিতেছিল সে অনুপাতে তাদের জন্য আসনসহ নতুন ও পুরাতন কিছু দলের জন্যও নির্বাচন করতে আমরা আসন বরাদ্দ করেছিলাম। কোন দল মানবে কিংবা কোন দল মানবে না -এটা বিবেচনা না এনে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আমাদের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আমাদের উক্ত সিদ্ধান্ত যারা মানবে, তারা তাদের স্ব স্ব দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে নির্ধারিত দল ও প্রতিকে নির্বাচন করতে হবে।
বর্তমানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আগের মতো না থাকায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের পক্ষ থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জন্য ২৪ টি আসন আগের মতো ঠিক রেখে বাকী ২৭৬ টি আসন নিয়ে তফসিল ঘোষণার পূর্বে আমাদের পক্ষ থেকে সংশোধিত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। যে সংসদীয় আসনে যে মতাদর্শের লোক বেশী, নির্বাচনে জিতে আসার জন্য সেই মতাদর্শের লোককেই প্রার্থী ঘোষণা করা হবে।
বাংলাদেশে তিনশত আসনে বেশী আর কম কার্যকর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা (আওয়ামীলীগের কার্যক্রম যেহেতু নিষিদ্ধ সেহেতু আওয়ামীলীগ ব্যতীত) বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রয়েছে। কোনো ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিবে না – এটার নিশ্চয়তা পেলে এবং বাংলাদেশ ঐক্য পার্টির ফর্মূলার আলোকে নেতৃত্ব ছাড় দিয়ে পাঁচ বছর দেশ চালানোর প্রতিশ্রুতি দিলে একই সাথে উক্ত দুইটি দলের সাথে নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে ঐক্য পার্টি প্রস্তুত। যদি দল দুটি রাজী না হয় তাহলে বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি যোগ্য প্রার্থী পাওয়া সাপেক্ষে একা তিনশত আসনেই ঐক্যমতের প্রার্থী ঘোষণা দিবে।
অতীতে যারা ক্ষমতায় গিয়েছিল, তারা ব্যর্থ হওয়ায় তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বাস করা বোকামি হবে। অন্যদিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে দেশের সার্বভৌমত্বের সাথে জান কোরবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেও আপোষ করবে না-এরকম নেতৃত্ব নির্বাচন খুবই জরুরি। সার্বভৌমত্বের শতভাগ সুরক্ষা এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও টেকসই করে নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড কিংবা উন্নত অন্যান্য দেশের মতো দেশকে রূপান্তরে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ ঐক্য পার্টির বিজয়ে দেশবাসীকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
লেখক: দেশীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি।
আপনার মতামত লিখুন :