joyosree mohan talukder
ফুলি আজ বড়দের মতো কথার উওর দেয় অজিতবাবুর মুখের উপর। ফুলি বলে আর যদি একবার আমার বাবা মা তুলে গালি দেওয়া হয় তবে আমি আর আপনার বাসায় থাকব না।অজিতবাবু হতবাক হয়ে যায় ফুলির কথায়। সেই কবে নোওয়াপাড়া চা বাগান থেকে অজিত বাবুর বড় শ্যালক প্রদীপ বাবু তার বোনের বাসায় ফুলি কে এনে দিয়েছিল, ছোট্ট নাতি কাব্য সাথে খেলা করার জন্য। কাব্য কে দেখাশুনা করা সহ এখন অনেক কাজই করতে হয় ফুলিকে যা ফুলির ভালো লাগে না।
পিরোজপুরের বিজয় নগর গ্রামে অজিত বাবুর বাস।পেশায় শিক্ষক। সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন অজিত বাবু। একমাত্র সন্তান অরিন্দম কে নিয়ে বিজয়নগরে প্রায় ১২ বছর যাবৎ বাস করছে।যদিও বদলীর চাকুরী তবুও অজিতবাবু সিদ্ধান্ত নিয়েছে শেষ জীবনটা উনি পিরোজপুরে থাকবেন। অনেক আত্নঅহংকারী মানুষ উনি।কলেজ থেকে ফিরে লেখালেখি করেন আর পুরোনো দিনের গান শুনেন।।অজিতবাবু বলেন লিখতে গেলে সাহিত্যের ছাত্র হবে।আজকাল লেখালেখির যে মান হয়েছে । সবাই কবি হতে চায়। দুই কলম লিখেই ছাপিয়ে নেয় বই।
ফুলির সাথে অজিত বাবুর সম্পর্কটা একটু অন্যরকম।ফুলিকে দেখলেই উনি রেগে যান। নাতি কাব্যর কারনেই ফুলির সকল বেয়াদবী মেনে নিতে হয়।বাগানে জন্ম হওয়ার কারনে ফুলি বড় ছোট সবাই কে তুই ডাকতে চায়। তার মনে থাকেনা কে তার চেয়ে বয়সে বড়। অজিত বাবুর পুএবধু কেয়া ফুলিকে খুব ভালোবাসে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফুলি বলে বৌদিমুনি আমাকে চা দিস। চা না খাইলে মোর শরীরে শক্তি আয়না। কেয়া হাসে। প্রতি সকালে কেয়াই ফুলিকে চা দেয়।প্রতিবছর এই দিনটির জন্য অজিত বাবুর পরিবার অপেক্ষা করে। আজ ১১ জুলাই। কাব্যর আজ জন্মদিন। অনেক ভোরে আজ ফুলি ঘুম থেকে উঠেছে।পাড়ার ফুল গাছ থেকে ফুল আনতে বের হয়েছে সে। রাস্তায় পাড়া প্রতিবেশী যার সাথে দেখা হয় তাকেই ফুলি খুব খুশী হয়ে বলে এই শোন বাবু আজ মোর কাব্যর জন্মদিন। তোরা মোর কাব্য কে আশীবাদ দিবি বুঝলি।তোরা সোবাই রাতে চাইনিজে আসবি। আমি তোদের নিমন্ত্রন দিচ্ছি। করোনা এখন না থাকলেও মাস্ক পড়ে আসতে ভুলিস না কিন্তু।
বাড়িতে নারায়ণ পুজা চলছে। অজিতবাবু নিজে পুজা করছে।কেয়া ও গিন্নি মা পুজোর যােগার করে দিচ্ছেন। ফুলি বলেছে বৌদি মনি আমাকে কেউ খাইতে বুলিস না। দেবতা পুজা শেষ না হইলে আমি খাইবেক না। কেয়া কাব্যর প্রতি ফুলির এই ভালোবাসা দেখে অবাক হয়। আত্নীয় পরিজন সহ প্রায় ২৫ জনের আয়োজন করা হয়েছে রাতে চাইনিজে।এখানে ফুলিকে নিয়ে যাবার ইচ্ছা বাড়ির কারো ছিল না। কেয়া বলেছে অরিন্দমকে ফুলি কাব্যকে দেখাশুনা করে সারাদিন। ফুলি যদি না যায় তাহলে সেও যাবে না।
বিজয় নগর গ্রাম থেকে শহরের দুরত্ব প্রায় ১৫ মিনিটের রাস্তা। শহরের চৌরাস্তায় নামকরা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট।10 পাউন্ডের একটি কেক নিয়ে অরিন্দম, কেয়া- কাব্য কে নিয়ে চাইনিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফুলি জেদ ধরেছে সে যাবে। কিন্তু অজিত বাবুর একদম ইচ্ছে নেই। ফুলি বলে অজিতবাবু কে তোদের যাবার দরকার নেই তোরা ঠাকুর মানুষ।ঐ জায়গায় মুরগী হবে। তোরা বাসায় থাক। বাড়ি পাহাড়া দে। আমাকে যাইবার দে।আমি না গেলে কাব্য কাঁদবে বুঝলি।
কেক কাটা হবে। নিমন্ত্রিত সব অতিথি এসেছে। কেয়া অরিন্দম যখন কাব্যকে নিয়ে কেক কাটতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে পিছন থেকে বৌদিমুনি আমাকে আসতে দে।আমাকে কাব্যর হাত ধরে কেক কাটতে দে।ফুলির কন্ঠ স্বর। সবাই যে যার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কে এই মেয়ে? অজিতবাবুর রাগান্বিত কন্ঠস্বর তুই যাবি না। ফুলির পাল্টা উত্তর আমি যাব। তুই এখানে এসেছিস কেন? যা তুই। বয়স হয়েছে বাড়িতে থাকবি।পরিস্থিতি অন্যরকম।কেয়া সামলিয়ে নিল সবকিছু। পরিচয় করিয়ে দিল সবার সাথে ফুলি কাব্যর বাগানের পিসি। কাব্যর সাথে খেলা করে।ফুলির মুখে ফুটে উঠল আনন্দের হাসি।
অরিন্দম ও কেয়ার বিয়ে হয়েছে প্রায় ৬ বছর হতে চলেছে। তারা দুজন দুজনকে খুব ভালো করে বোঝে।কারো মনের কথা কেউ না বললেও বুঝতে পারে।কেযার ইচ্ছে সে কিছুদিন তার মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে। গতবছর তাঁ বাবা মারা যাবার পর থেকে মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কেয়ার বাপের বাড়িতে যাবার কথা শুনা মাত্রই অজিতবাবু স্থির থাকতে পারছে না আজ। নাতি কাব্যকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না।কেয়াকে গিন্নি মা বলেছে এই করোনার সময় তাদের ইচ্ছে নেই নাতিকে ঘরের বাইরে বের করা। কেয়ার মনের অবস্থা খুব খারাপ ।সারাদিন সে মায়ের জন্য কঁাদাকাটি করে।ফুলি কেয়ার চোখের জল একদম সহ্য করতে পারে না।কেয়ার মধ্যে সে তার মা শেফালী কে দেখে। কেয়ার চোখে দেখে সে মায়ের স্নেহ।আজ বেশ কিছু দিন ধরে অজিতবাবু ও ফুলির মধ্যে সম্পর্কটা খুবই খারাপ চলছে। অজিত বাবুর সব কথার মুখে মুখে উওর দেয় ফুলি। জোরে জোরে সবাই কে শুনিয়ে বলে তোর নাতিকে চাইনিজে নিয়ে গিয়ে জন্মদিন করছিস, গিন্নী মা সিলেটে যাচ্ছে তার বাপেরবাড়ি আর বৌদিমুনি তার বাপের বাড়ি বাগেরহাটে যেতে চাইলেই যত ভয় তোদের।তোরা একদম তোর ছেলের বউ কে ভালোবাসিস না। চল গিয়ে দেখবি নোওয়াপাড়া বাগানে আমাদের বড়বাবু কিরন তার ছেলের বউ কে কতো ভালোবাসে।অজিতবাবু ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে বলে আজ অরিন্দম আসলে এর একটা বিহিত করতে হবে।
সোনালী ব্যাংক সিনিয়র অফিসার অরিন্দম।বাগেরহাটে যখন সে ছিল তখন কেয়ার সাথে বিয়ে হয়।বাবা মায়ের পছন্দেই অরিন্দম বিয়ে করে। আজ অফিস থেকে, ফিরার পরে বাবার কাছ থেকে তাকে অনেক কথাই শুনতে হয়েছিল ফুলিকে নিয়ে।সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে কি করবে। রাতে চোখে ঘুম আসে না ফুলির কথা মনে পড়ে। গতবছর মার্চ মাসে যখন কেয়ার করোনা হয়ছিল তখন ফুলি নিজের জীবনের ভয় না করে যে সেবা করেছিল তা কখন ভুলার নয়। স্বামী হয়েও সে সেটা করতে পারেনি। কাব্য প্রতি ফুলির অকৃত্রিম ভালবাসা সবার চোখে পড়ে।কিন্তু কেন সেই ছোট্ট মেয়েকে তার বাবা ভালোবাসে না এটা সে মেনে নিতে পারছে না। ফুলির মধ্যেই অরিন্দম খুঁজে পায় তঁার বোনকে।
মাএ ৮ বছর বয়সে অজিতবাবুর একটি মেয়ে মারা গিয়েছিল। সেই থেকেই উনি একটু অসামাজিক। প্রত্যেকদিনের মতোই ফুলি আজ ঘুম থেকে উঠে আর হরে কৃষ্ণ গান গায়। তারপর চলে সারাদিন তার পছন্দের এক গান।সে এখন জানে না আজ তার জীবনে কি ঘটতে চলেছে।
ফুটবল খেলা দেখতে তার খুব ভালো লাগত।পাড়ার বেশকিছু মানুষ আর্জেনটিনাও ব্রাজিলের ফাইলাল খেলা দেখবে অজিতবাবুর বাসায়। ফুলির খুব আনন্দ।সে অরিন্দমকে বলেছে দাদা বাবু আমি আর্জেনটিনার পক্ষে। যদি আমার দল জিতে তাহলে তুই মেসির একটা ছবি আমাকে এনে দিবি। আমি যখন বাড়িতে যাব তখন ওকে সঙ্গে নিয়ে যাব।দেয়ালে ওর ছবি লাগিয়ে রাখব। দিবি তো বল। অরিন্দম হেঁসে বলেছিল তোকে দশটা ছবি কিনে দেব। ফুলি বলেছিল এই না হলে আমার দাদাবাবু।
খেলা জমে উঠেছে। আর্জেনটিনাে একটা গোল দিয়েছে। গিন্নি মা চা তৈরি করছে সবার জন্য। কেয়াকে বলেছে খেলা দেখার জন্য। ফুলি খেলা দেখছে আর সবার হাতে হাতে চা এনে দিচ্ছে। অজিতবাবুর জন্য জল আনতে গিয়ে ফুলি দেখে গিন্নি মায়ের শাড়ি তে গ্যাসের চুলা থেকে আগুন ধরেছে। ফুলি চিৎকার দেয় আগুন আগুন।তোরা কে কােথায় আছিস। আমার গিন্নি মাকে বাঁচা।ফুলি সবার জন্য অপেক্ষা না করে গিন্নি মাকে ফেলে দিয়ে শাড়ি খুলে নেয়। শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যায় গিন্নি মার। কিন্তু সবাই যখন আসে তখন ফুলি জ্বলছে আগুনে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া ফুলিকে খুব তাড়াতাড়ি নেওয়া হয় পিরোজপুর সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার কর্তব্য ডাক্তারা কিছুই করতে পারে নি। তার আগেই ফুলি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ফুলির মৃত দেহের পাশে অরিন্দম রেখেছিল তার প্রিয় ফুটবল তারকা মেসির ছবি। মৃত্যুর মাএ একদিন আগে অরিন্দমের কাছে চেয়েছিলো ফুলি এই ছবি।
বিজয়পুর গ্রামের সব মানুষ দেখেছিল ফুলির প্রতি অরিন্দম ও কেয়ার ভালোবাসা। রক্তের কোন সম্পর্ক নেই ফুলির সাথে কিন্তু সেদিন দেখে সবার মনে হয়েছিল ফুলি অরিন্দমের ছোট বোন।
নোওয়াপাড়া চা বাগানের মধ্যে দিয়ে ফুলির লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার বাড়িতে। চিতার আগুন না নেভা পর্যন্ত অজিত বাবু কারো সঙ্গে কোন কথা বলেনি।শেষ সময়ে ঈশ্বরের কাছে তার প্রার্থনা ছিল নিজের জীবনের বিনিময়ে ফুলিকে ফিরিয়ে দেয়া।
ফুলির মধ্যে দেখে সে তার মেয়ে কে।অপরাধের জন্য ক্ষমা চায় ঈশ্বরের কাছে। মনে পড়ে অজিতবাবুর ফুলির সেই প্রিয় গান যেটা সে সারাদিন গাইত তুই যে আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে যাকে নিয়ে স্বপ্ন আমার ঝরতো দুচোখ বেয়ে।
সমাপ্ত।
মন্তব্য করুন