
শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী হিসেবে রাহিমা বেগমের দাপট আকাশচুম্বী। তার ইশারায় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য চলে, বিশাল অট্টালিকার জাঁকজমক দেখে লোকে ঈর্ষা করে। জীবনের পুরোটা সময় তিনি ব্যয় করেছেন সম্পদ বাড়াতে আর অন্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে। তার কাছে জীবন মানেই ছিল এক নিরন্তর লড়াই আর জেতার নাম।
একদিন বিকেলে বাগানবাড়ির ইজিচেয়ারে বসে রাহিমা বেগম যখন নিজের সাম্রাজ্যের দিকে তৃপ্তির নজরে তাকাচ্ছিলেন, ঠিক তখন পুরনো এক বান্ধবী পারুল বেগমের সাথে তার দেখা হয়। পারুল সাধারণ একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন, এখন অবসরে। রাহিমা বেগম বেশ দম্ভের সাথে বললেন, “দেখলে পারুল, শূন্য হাতে এই শহরে এসেছিলাম, আজ কত কিছু আমার দখলে! এই পুরো শহরটা এখন আমার প্রাচুর্য চেনে।”
পারুল বেগম মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক বলেছ রাহিমা। তবে একটা কথা ভেবে দেখেছ কি? আমরা যখন এসেছিলাম, আমাদের মুষ্টিবদ্ধ হাতে কিছুই ছিল না। আর যখন যাব, তখন হাত দুটো থাকবে একদম খোলা—সেখানেও কিছু থাকবে না। মাঝখানের এই সময়টুকুতে আমরা যা নিয়ে মরণপণ লড়াই করি, তা আসলে আমাদের নয়; আমরা কেবল সেগুলোর ক্ষণস্থায়ী পাহারাদার মাত্র।”
রাহিমা বেগম তখন কথাটি হো হো করে উড়িয়ে দিলেও, নিয়তি তার জন্য অন্য কিছু লিখে রেখেছিল। সেই রাতেই তীব্র হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি হলেন। সাদা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, তার পাহাড় সমান সম্পদ তাকে এক মুহূর্ত বেশি শ্বাস নেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। বাইরে যখন তার সন্তানেরা মায়ের সুস্থতার চেয়ে সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে, তখন রাহিমা বেগমের কানে পারুল বেগমের কথাগুলো বারবার কানে বাজতে লাগল— “আমরা কিছুই নিয়ে আসি না, তবুও সবকিছুর জন্য লড়াই করি…!”
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর রাহিমা বেগম বদলে গেলেন। তিনি তার অট্টালিকার সামনে একটি বড় বোর্ড টাঙিয়ে দিলেন, যেখানে লেখা ছিল: “পৃথিবীর এই সরাইখানায় আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি।”
তিনি তার সম্পদের একটি বড় অংশ দিয়ে গড়ে তুললেন এক ‘শান্তি নিবাস’। সেখানে বিত্তবান আর সুবিধাবঞ্চিত মানুষ একই কাতারে বসে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ পেল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাহিমা বেগম উপলব্ধি করলেন, নিজের ‘আমি’কে বিসর্জন দেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি। মৃত্যুর মিছিলে শামিল হওয়ার আগে তিনি কেবল এটুকুই বুঝলেন—জীবন জমানোর নয়, বরং বিলিয়ে দেওয়ার নাম। কারণ শেষ বিদায়ে পিঠের ঝুলিতে এক চিমটি ভালোবাসা আর কিছু মানুষের দোয়া ছাড়া আর কিছুই নেওয়ার সুযোগ নেই।
নীতিকথা: জীবন বড়ই অদ্ভুত। আমরা রিক্ত হস্তে পৃথিবীতে আসি, মায়ার পেছনে ছুটে জীবনভর লড়াই করি, অথচ দিনশেষে সেই রিক্ত হস্তেই চিরচেনা পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়।
লেখক: সাংবাদিক হাবিবুর রহমান হাবিব।
শাল্লা-সুনামগঞ্জ।
আপনার মতামত লিখুন :