মাহবুবুল আলম
সামারে আমেরিকার বাংলাদেশি অভিবাসীরা
থাকে অনেকটাই উৎসবের আমেজে। এককথায় বলতে গেলে আমেরিকার পঞ্চাশটি স্টেটে উইকএন্ডে চলছে কোনো না কোন সংগঠন ও এসোসিয়েশনের বাঙালিয়ানা পিকনিক পার্টি। এসব পিকনিক পার্টিতে ভূড়িভোজের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্যের নানাবিধ খেলাধূলার প্রগিযোগিতা নৃত্যগীতি রাফেলড্র সহ বিভিন্ন ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে। আমেরিকার ব্যস্ততম কর্মজীবনের মাঝেও এসব পিকনিক উৎসব ঘিরে বাংলাদেশি অভিবাসীরা মেতে ওঠে উচ্ছল আনন্দ উৎসবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশিগণ সামার এলেই পরিবার-পরিজন বন্ধুবান্ধ মিলে নানান উৎসব আয়োজন করে থাকে। কেননা, এখানে প্রায়
আট মাস শীত থাকে। যা চলে অক্টোবর থেকে মধ্য ‘মে’ পর্যন্ত। কখনো তীব্র হাড়কাঁপানো শীত, কখনো ভারি তুষারপাতেের শুভ্র চাদরে ঢাকা থাকে পথ-ঘাট-বৃক্ষ, বন-বনানী। সেসময় বরফে ঢেকে থাকে বাড়ি-ঘরের ছাদ লন বারান্দাও। তাই এই সময়টাতে খুব প্রয়োজনে না হলে কেউ ঘরের বাইর হয় না। অফিস আদালতে মানুষ হিটিং গাড়িতে চলাচল করে। এখানে বাড়িঘর, অফিস আদালত, শিল্প-কারখানা, সকল ধরনের যানবাহনেই হিটিং সিস্টেম বিদ্যমান। হিটিং সিস্টেম ছাড়া এখানে সবকিছু স্থবির ও অচল।
আমেরিকায় স্প্রিং (বসন্তকাল) খুবই স্বল্পকাকীন।
বসন্ত আসতে না আসতেই যেন কেবল যাই যাই
নেড়া গাছে গাছে কচি সবুজ পাতা ও নানান রঙের৷ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ভরে ওঠে বাড়ি ঘরের আঙ্গিনার ও বাগানগুলো। এসময় পথে পথে নজর কাড়ে লাল সাদা চেরি বাগানগুলো।
যাক যা নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। বলছিলাম
আমেরিকায় বাংলাদেশি৷ অভিবাসীরা স্প্রিং ও সামারে এখানে যেসব উদযাপন করে তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো। প্রথমেই আমি মিশিগানে বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন নিয়ে শুরু করছি।
মৌলভীবাজার এসোসিয়েন অব মিশিগান এর
বার্ষিক বনভোজন ২০২৪ হয়ে গেল ২১ জুলাই
লেক সেন্ট ক্লেয়ার মেট্রো পার্কে। মৌলভীবাজার
এসোসিয়েশন অব মিশিগান কতৃক আয়োজিত দিনব্যাপী পিকনিক ও মিলনমেলায় আমি ও আমার
স্ত্রীকে নিয়ে উক্ত যোগ দিয়েছিলাম। সব বয়সের প্রায় চার শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ও যুবাদের পদচারণায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছিল মেট্রোপার্ক
ও সি-বীচের মনোরম ও নান্দনিক পরিবেশের উৎসব ভ্যনুটি। বিশাল আয়োতনের এ ভ্যনুর একদিকে
লেক অন্যদিকে বীচ।
আমেরিকায় অন্যতম বড় আঞ্চলিক সংগঠন মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট সোসাইটি অব ইউএসএ ইনক এরা প্রতি বৎসরই বার্ষিক বনভোজন ও মিলনমেলা আয়োজন করে থাকে। সবার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে তাদের আয়োজন সত্যিকারের মিলনমেলায় রূপ নেয়।
রোববার (৪ এপ্রিল) নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের মেনোরভিলে এ পিকনিকের আয়োজন করা হয়। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সদস্যরা খাওয়া-দাওয়া, গান, কৌতুক, স্মৃতিচারণসহ নানা কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠেন। এতে আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশি কমিউনিটির মাঝে ঐক্য, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ওয়ারেন সিটির হলমিচ পার্কে গত ৭ জুলাই ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আনন্দের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগানের চতুর্থতম পিকনিক। এতে ছিল খেলাধুলা, কুইজ প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাফেল ড্র ও জমজমাট আড্ডা। পিকনিকের বিশেষ আকর্ষণ ছিল কুইজ (সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন) প্রতিযোগিতা। ১৫ মিনিটের শিক্ষনীয় এ প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন উপদেষ্টা শাহ খালিশ মিনার ও সহকারী অধ্যাপক আমিনুল হক। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ ও রাফেল ড্র বিজয়ীদের আকর্ষণীয় পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্রচন্ড গরমের মধ্যেই মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরবাসী আয়োজন করে পিকনিক পার্টি ও মিলনমেলার। সব ধরণের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেও এ আয়োজনে সমবেত হয়েছে সকল শ্রেণিপেশার শত শত বাঙালি। ৭ জুলাই তাদের বার্ষিক বনভোজন হয় নিইউয়র্কের কর্টন পয়েন্ট পার্কে। হার্ডসন নদীর পাশে ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ এক সবুজ পরিবেশ যেন আপন করে নিয়েছিল এসব বাঙালিদের। আর তাই তো প্রায় ছয়শত অতিথি মেতেছিলেন আনন্দে । বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনা এবং আনন্দঘন পরিবেশে দিনটি পার করেন বাঙালিরা।
আর সেই সুযোগটি করে দিয়েছিল মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর এসোসিয়েশন ইন্ক।
নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কর্মরত বাংলাদেশী স্কুল সেফটি অফিসারদের সংগঠন বাংলাদেশি-আমেরিকান স্কুল সেফটি অ্যাসোসিয়েশন (বাসসা) আয়োজিত দ্বিতীয় বার্ষিক বনভোজন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিউইয়র্কের ওয়েস্টচেষ্টার কাউন্টির ক্রোটন পয়েন্ট পার্কে ৫ জুলাই দিনব্যাপী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত স্কুল সেফটি অফিসারেরা ও তাদের পরিবার এতে অংশ নেন । প্রায় তিনশতাধিক সদস্য যোগ দেন এই মিলন মেলায়।
প্রকৃতির নয়নাভিরাম সবুজে ঘেরা ক্রোটন পয়েন্ট পার্কের লেকের পাশে পিকনিকের স্থানটি হয়ে ওঠে যেনো একটুকরো বাংলাদেশ। বনভোজন শুরু হয় সকাল নয়টায়। সকাল থেকেই নিউইয়র্কের বিভিন্ন এলাকা থেকে অংশগ্রহণকারীরা ক্রোটন পয়েন্ট পার্কে জড়ো হতে থাকেন। এরপর শুরু হয় মূল পর্ব ছোটদের ও বড়দের খেলাধুলার অনুষ্ঠান। এতে স্কুল সেফটি অফিসারদের পরিবার ও সন্তানেরা অংশ নেয় । বিভিন্ন রকম দৌড় প্রতিযোগিতা, বালিশ যুদ্ধ, হাঁড়ি ভাঙা খেলাসহ নানান রকম খেলায় অংশ নেয় প্রতিযোগীরা।
কুমিল্লা সোসাইটি অফ ইউএসএ ইনক এর বনভোজন ৩০ জুন ২০২৪ রবিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুমিল্লা সোসাইটি অফ ইউএসএ ইনক এর বনভোজন করে। মিশিগানের অভিবাসরা সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সামাজিক আয়োজনেও পিছিয়ে নেই। সবচেয়ে খুশির খবর হলো এবার উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম বাংলাদেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ফোবানার ৩৮তম সম্মেলন হচ্ছে মিশিগানের ডেট্রয়েটে। আয়োজক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশান অব মিশিগান। ওয়ারেন সিটির একটি রেস্টুরেন্টে গত ৩০ জুন দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকেরা এ সম্মেলনের বিভিন্ন বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরেন। আগামী ৩০, ৩১ আগষ্ট ও ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ফোবানার ৩৮তম সম্মেলন মিশিগানের ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হবে বাংলা টাউনখ্যাত ডেট্রয়েটের জেইন ফিল্ডে এবং হোটেল একোমডেশান সাউথ ফিল্ডের হিলটন গার্ডেনে।
সম্মেলনে থাকবে বিশেষ সেমিনার, ওয়ার্কশপ, আলোচনা সভা, বিজনেস নেটওয়ার্কিং সামিট, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান, বাউল সন্ধ্যা, ব্যান্ড শো, সিনেমা, স্লাইড শো, আর্ট এগজিবিশান, ফ্যাশন শো, ট্যালেন্ট শো, ইয়থ ফোরাম, নাটক, নৃত্য, ফটো প্রদর্শনী, লটারি, রাফেল ড্র, দেশীয় আড্ডা, শতাধিক স্টল যাতে থাকবে বাংলাদেশি কাপড়, খেলনা, ঘর সাজানোর জিনিস ও রকমারি খাবারের দোকান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বাংলাদেশ ও উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় শিল্পীদের গান ও নৃত্য। থাকবে কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে আড্ডা কাব্য জলসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জলবায়ু বিষয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে থাকবে বিশেষ আয়োজন।
সম্মেলন উপলক্ষে একটি বহুবর্ণা স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে বলে সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন। সম্মেলন উপলক্ষে বিভিন্ন কমিটি, উপকমিটি ইতোমধ্যেই গঠন করা হয়েছে এবং আরও কাজ চলমান রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ফোবানার চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান বলেন, ‘ফোবানার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, প্রবাসে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশিদের বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া, বাংলার কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা।’ তিনি মিশিগানে একটি বাংলাদেশ কনস্যুলেট খোলার ব্যাপারে ফোবানার মাধ্যমে জোর দাবি জানাবেন এবং এ ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে উল্লেখ করেন।
পরিশপষে, কয়েক হাজার মাইল দূরের আমেরিকাতে বাংলাদেশিরা বসবাস করলেও দেশের সংস্কৃতি কৃষ্টি
ও ঐতিহ্যের কথা কখনো বিস্মৃত হয় না। মন ও মননে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে লালন করে বাংলা নববর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বাংলাদেশের সব জাতীয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে থাকেন আমেরিকার অভিবাসী বাংলাদেশিরা। দেশে যতই রাজনৈতিক ভেদাভেদ থাকুক না কেন এখানে যেন এক সুতোয় গাঁথা।
২৪ জুলাই ২০২৪
ডেট্রয়েট, মিশিগান, ইউএসএ
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন