দিন কারো জন্য থেমে থাকে না। হয়তো আমাদের তরুলতা সব কিছু মানিয়ে নেবে। বাঁচতে শিখবে নতুন করে।কিন্তু আজকে কেন জানি চোখ বন্ধ করেই শুধু ভাবতে ইচ্ছে করছে তরুর কথা। কি সুন্দর দেখতে ছিল মেয়েটি।মন থেকে সরাতে পারছি না ওকে। মামী করে ডেকে বলতো ভালো আছো নি মামী।মামা ভালো নি। আমি মাথা নেড়ে বলতাম ভালোরে মনা। তুই ভালো আছিস। ধীরে বলতো অয় গো মামী। ঈশ্বরের কাছে বার বার বলতে ইচ্ছে করছে কি পাপ করেছিল মেয়েটি?
আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের তরু পড়াশুনা শেষ করেছিল। বিয়ে হয়েছিল আসামের এক উকিলের সাথে। আমার ছোট ননদ জামাইকে পছন্দ করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল। তরুর বরকে আমি ডাকতাম রতন করে। প্রতিবছর একবার করে রতন সিলেট আসত তরুকে নিয়ে। রতনের মামার বাড়ি ছিল সিলেটের সুনামগন্জে।
তরু ছোটবেলা থেকেই অনেক শান্ত ছিল। রতনের সাথে সর্ম্পকের কথা প্রথম আমাকেই জানিয়েছিল তরু।বলেছিল মামী গো বাবা মাকে বলো আমি আসামে বিয়ে করবো.।অর্থনীতি নিয়ে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে গিয়েছিল তরু। আমার ননদ রীতা দিদি খুব ভালো বাসতেন তরুকে। ছেলে শুভ কে বলত আমি শেষ জীবনে তরুর সাথে থাকব। তোর সাথে থাকবে তোর বাবা। দিদি প্রায়ই বলতো সবাইকে তরুকে পাবার জন্য দিদির অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল । মাত্র ৮ মাসে জন্ম হয়েছিল তরুর।
রতন আর তরুর বিয়েতে আমি ও আমার স্বামী গিয়েছিলাম আসামে। বড় একটি বাসা ভাড়া করেছিল আমার ননদ।সেখানেই আমরা বাংলাদেশের সকল আত্নীয় উঠেছিলাম। অনেক আনন্দ হয়েছিল তরুর বিয়েতে। তরুর বিয়ের পর রতন তরুকে নিয়ে আসামের শিলচরে থাকতে শুরু করে। শিলচরে দোতলা বাড়িতে তরু সাজিয়ে নেয় তাঁর সংসার। বিয়ের দুবছরের মাথায় তরুর কোল জুড়ে আসে প্রথম পুত্র সন্তান অভি। অভিকে নিয়ে তরু একবার বাংলাদেশে এসেছিল। শিলচরে তরুর বরকে সবাই চিনত। গরীব মানুষ যদি রতনের কাছে কোন সাহায্য নিয়ে যেত রতন মন খুলে তাঁদের সাহায্য করত।কারো দুঃখ রতন মন থেকে মেনে নিতে পারত না।
বিয়ের পর থেকে রতন সকল আত্নীয় স্বজনদের মন জয় করে নিয়েছিল।কেউ ভারতে চিকিৎসার জন্য গেলে রতন তাঁদের অনেক সাহায্য করতো। কেউ পেত অর্থ, কেউ পেতো সাহস, কেউ পেতো থাকার ব্যবস্থা। এমনকি আমার বাবাকে দেখাতে যখন ভারত গিয়েছিলাম তখন রতন আমাদের সাথে চেন্নাই পর্যন্ত গিয়েছিল।রতনের খুব ইচ্ছে ছিল একটা কন্যা সন্তানের। তরুকে বলত রতন মেয়ে না হলে তরু ঘর টা কেমন যেনি ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ২০১৪ সাল তরু দ্বিতীয় সন্তানের মা হবে। তরুকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। দিদি ও জামাইবাবু অনেক খুশি। তরু কিছুদিন বাংলাদেশে থাকবে জন্য। রতন সাথে এসেছে। সিলেটের নামকরা গাইনীর ডাক্তার সবুরের কাছে নেয়া হলো তরুকে। চেম্বারে অপেক্ষা করছে তরু, রতন ও দিদি। হঠাৎ রতনের পিঠে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়। রতন স্থির থাকতে পারে না। বাসায় চলে আসতে হয় সবাইকে।
দিদি ফোন করে আমাদের। আমি ও আমার স্বামী ছুটে যাই দিদির বাসায়। সন্ধ্যা ৭টার ঠিক একটু আগে রতনের মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। অনেক রক্ত।আমি আগে কখনো মানুষের মুখ দিয়ে এমন রক্ত বের হওয়া দেখি নাই। রতন তখনো স্বাভাবিক। দেখে মনে হয় কিছুই হয় নাই। মুখে হাসি। রাতের খাবার খেতে চায় তরুর কাছে।তরু আমাকে নিয়ে যেতে চায় সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে।কিন্তু রতন রাজি নন। সে বলে তাঁর কিছুই হবে না।সে সুস্থ আছে। আমি পাশে দাড়িয়ে থেকে দেখছি রতন শুধু ঘামছে।
রাত ১০.৩০ মিনিট। রতনের আবার রক্ত বমি শুরু হয়। এবার রক্ত বমির পরিমান অনেক বেশি। কোন ভাবেই থামছে না। দ্রুত এম্বুলেন্স করে ওসমানী মেডিকেলে নেয়া হয়। লাইফ সাপোর্ট নেয়া হয় রতনকে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রতনের প্রেসার বাড়াতে পারছে না ডাক্তাররা। রক্ত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি নেই।অক্সিজেনের লেভেলও কমে আসছে।।
রাত ৮টার দিকে তরু আমাকে বলে রতনকে দেখতে যাবে। ঠিক সেই সময় কর্তব্যরত ডাক্তারা জানায় রতন মারা গেছে। তরু সেই সময় পুরো স্বাভাবিক ছিল। সবাইকে সাহস দেয় তরু।রতনের দেহ কিভাবে শিলচর নেয়া হবে তাঁর ব্যবস্থা করে তরু। আমি অবাক হই তাঁর আচরন দেখে।আমাকে বলে মামী আমাকে বাংলাদেশ থেকে একটু খেয়ে যেতে হবে। কারন শিলচরে কে খাবার দেবে আমায় বলো মামী?রতন আসলে কোন অসুখে মারা গেল আমরা আজও ভাবি। সুস্থ রতন বাংলাদেশে আসল আর লাশ হয়ে ফিরে গেল।
আমি ও আমার স্বামী রতনের লাশ নিয়ে তরুর সাথে গিয়েছিলাম শিলচরে। রতনের দাহ হবার পরেওআমাকে থেকে যেতে হয় তরুর সাথে আরও দুমাস।তরুকে দেখে মনে হত কিছুই জানে না সে কিছুই বোঝে না। সকাল হলেই জানালায় দাঁড়িয়ে তরু চিৎকার করে রতনকে ডাকত আর বলত তোমার মেয়ের নাম কি রাখব? তুমি না বললে আমি বুঝবো কি করে বলো। দ্বিতীয় বারের মতো তরু আবারো মা হয়।জন্ম নেয় কন্যা সন্তান।
আজ তরু স্বাভাবিক। মানিয়ে নিয়েছে ঈশ্বরের দেয়া জীবন। কিন্তু তরু তো কথা বলে না কারো সাথে। ভারতের অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখেছে তরুকে। সব ডাক্তারদের এক অভিমত সব কিছু ঠিক আছে তবে কেন সে কথা বলে না ডাক্তার গন বুঝতে পারে না হয়তো অভিমান রতনের প্রতি,নয়তো প্রচন্ড ভালোবাসা। আমি স্বপ্ন দেখি তরু ডাকবে আমায় বলবে মামীগো আমি তো বাংলাদেশে আসছি। মিষ্টি করে করে বলবে অয় গো মামী, মামা ভালোনি।
সমাপ্ত।।
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অনলাইন লেখিকা জয়শ্রী মোহন তালুকদার।
মন্তব্য করুন