সৈয়দ মতিউর রহমানঃ
রাজনীতির বাতিঘর, নির্ভিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও
। সৈয়দ উবায়দুর রহমান শরিফ।।
জগৎসংসারে কারও আগমনই চিরোস্থায়ী নয়। কবির ভাষায় ‘ জন্মিলে মরিতে হবে, ওমর কে কোথায় কবে’। এ ক্ষণিকের আগমন, কিছুকাল অবস্থান, অতঃপর আপন গন্তব্যে চিরোপ্রস্তান এ তিন অবস্থার মাঝে পরম শ্রষ্ঠার সৃষ্টিজগৎ বিরাজিত। মায়াময় ধরণীতে এই ক্ষনিকের অবস্থানকালীন সময়ে কেহ কেহ স্বীয় জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, প্রতিভা, বীরত্ব আর মননশীলতার দ্বারা এমন কিছু কৃতিত্ব রেখে যেতে চান যাতে মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার যেসব কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ অমরত্বের আসন করে নেন এই মাটির পৃথিবীতে। তারা স্বরণীয় বরণীয় হয়ে থাকেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যুগ যুগ ধরে। তেমনি এক ক্ষনজন্মা বিরল প্রতিভা আর নিভিকতার অধিকারী ছিলেন মরহুম সৈয়দ মতিউর রহমান। তৎকালীন সময়ে বৃহত্তর বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ২নং পতনঊষার ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম শ্রীরামপুরে এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত মসলিম পরিবারে পিতা সৈয়দ মফিজুর রহমানের ঔরসে আর মাতা নজিবুননেছা চৌধুরীর গর্ভে ১৯৩৮ সালের কোনো এক আনন্দঘন মুহুর্তে পিতৃকুল এবং মাতৃকুল আলোকিত করে জন্ম নেন এই অনিন্দ্য সুন্দর ফুটফুটে শিশুটি। পিতা মাতার দেয়া ডাক নাম ছিল সুলেমান। চার বোনের একমাত্র ভ্রাতা ছিলেন তিনি এবং পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তার পিতা মাতার দ্বিতীয় সন্তান। সৈয়দ মতিউর রহমানের পূর্বপুরুষ ছিলেন ওলিকুল শিরোমনি হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রঃ) সহ ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সহচর হযরত সৈয়দ শাহ রুকন উদ্দীন (রঃ)। শ্রীহট্ট বিজয়ের পর ইসলামের সুমহান পয়গাম দিক বিদিকে পৌঁছে দিতে হযরত শাহজালাল(র.) এর নির্দেশ মোতাবেক হযরত সৈয়দ শাহ রুকন উদ্দীন (রঃ) বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার কদমহাটা নামক স্থানে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। এখানেই তার মাজার বিদ্যমান রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় সৈয়দ মতিউর রহমান এ ধারার সপ্তম পুরুষ হিসেবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে পাওয়াযায়। সৈয়দ মতিউর রহমান পঞ্চাশের দশকে স্কুল ছাত্রাবস্থায় পিতার সহায় সম্পদ আর প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতি তোয়াক্কা না করে গরিবের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, মহান ভাষা আন্দোলনের একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে মৌলভীবাজার জেলার প্রগতিশীল রাজনীতি সূচনাকারীদের মধ্যে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং অনেক আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেন। তিনি ছিলেন সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি কুলাঙ্গার বাহিনী যখন নির্বিচারে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞ শুরু করে তখনকার এক ভোরে তার প্রথম পুত্র কাজল এর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটে। প্রাণপ্রিয় শিশু পুত্রের লাশ দাফন সেরেই পৃথিবীর অত্যন্ত নির্মম পুত্র শোক বুকে ধারন করে তৎক্ষনাৎ তিনি দেশ মাতৃকার টানে ও মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল নির্ধারণের পূর্ব প্রস্তুতির জন্য তাঁর ফুফাতো ভাই ও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু সৈয়দ সাইদুর রহমানকে একমাত্র সঙ্গী করে লুঙ্গী-গেঞ্জি পরা অবস্থায় মাত্র পাঁচ টাকা নিয়ে পায়ে হেঁটে ভারতের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন। যাত্রা পথে পাকদস্যু ও তাদের দোসর শান্তি কমিটির সদস্যদের বহুবিধ বাধা বিপত্তি অত্যন্ত কৌশলে অতিক্রম করতে হয়েছে উভয়কে। সৈয়দ মতিউর রহমান শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে। তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে আজীবন অবিচল ছিলেন এবং আমৃত্যু ন্যাপের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ এর পর তিনি তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়ে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘ দিন কারাভোগ করেন। রাজনীতির পাশাপাশি সৈয়দ মতিউর রহমান একজন প্রতিবাদী সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি মৌলভীবাজার ইউনিটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দৈনিক সংবাদ এবং দৈনিক বাংলার সিনিয়র স্টাফ এবং দৈনিক নওবেলাল পত্রিকার সহসম্পাদক পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। একসময় সিলেটের যুগভেরীতেও প্রচুর লেখালেখি করেছেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যেমন নিজ আদর্শে অবিচল ছিলেন তেমনি একজন সাংবাদিক হিসেবেও ছিলেন আপোষহীন। সে কারণে নিত্যদিনই তাকে নানবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২৬ শে আগস্ট ১৯৯৯ সালে ৬১ বৎসর বয়সে এই ক্ষণজন্মা পুরুষের বর্ণাঢ্য জীবনের চির অবসান ঘটে। পরদিন ঢাকা থেকে স্বজনরা তাঁর লাশ সড়কপথে মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের আঙ্গীণায় নিয়েএলে প্রেসক্লাবের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবাদিক সহকর্মী সহ সর্বস্তরের গণমানুষেরা এখানে তাঁর লাশের প্রতি ফুলেফুলে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শেষ বিদায় জানানোর পর জন্মস্থান শ্রীরামপুর দ্বিতীয় জানাজা শেষে এ গ্রামেই পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
একসময়ে দরিদ্রের চরম কষাঘাতে জর্জরিত গরিবের অধিকার আদায়ে আজীবন নিবেদিতপ্রান এ গুণিজনের গ্রামের একমাত্র বসতঘরটি আর আগেরমতো টিনশেডের আধাকাঁচা নেই। তার পরিবর্তে এখন শোভাপাচ্ছে শহরের বৈচিত্রময় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত সৌন্দর্যময় একতলা পাকাঘর। তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানের সবাই এখন বৃটেন, অস্ট্রেলিয়ার মত উন্নত দেশের স্থায়ীভাবে বাসিন্দা। সৈয়দ মতিউর রহমানের বড়ছেলে সৈয়দ মিজানুর রহমান সজল মাতা,স্ত্রী-সন্তান সহ এবং একমাত্র মেয়ে সৈয়দা রওশন জাহান পাপড়ী ও তাঁর স্ব-পরিবার যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা। ছোট ছেলে সৈয়দ মুহিতুর রহমান পরাগ স্ব-স্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা।
সৈয়দ উবায়দুর রহমান শরিফ – প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, সিলেট প্রতিনিধি- দ্য সিলেট পোস্ট)।
আপনার মতামত লিখুন :