১৯২১ সালের ১ জুলাই পাঠদানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঢাবি প্রতিষ্ঠার ১০৩ বছর পর এর প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে একটি মহল কিছু দিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনাহুত বিতর্কের সৃষ্টি করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক মন-মননের এ গোষ্ঠী দেশে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না থাকলে নানা উছিলায় সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সংঘাত সৃষ্টির পায়তারা করে থাকে। এখন কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরোধিতা করেছিলেন বলে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সেই একই কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরোধিতা করছিলেন বলে কোনো দালিলিক প্রমাণ ছাড়া মনগড়া বক্তব্য তুলে ধরে বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ‘ভারত হঠাও’ এবং বয়কট ইন্ডিয়া হ্যাসট্যাগ ক্যাম্পেইন মাঠে যাওয়ার পর নবাব স্যার সলিমউল্লা খান ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছ।
এ বিষয়ে বিভিন্ন সোর্সে খোঁজ নিয়েও নবাব সলিমুল্লাহ কতৃক এমন কোনো দান দলিল বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রকার নথি পাওয়া যায় নাই যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি দান করেছেন। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্র কেউ এমন কোনো দাবিও কখনো করেন নাই। অন্যদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছেন এমন কোনো তথ্য প্রমাণ বা তৎকালীন কারও সাক্ষ্যও পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা থেকেই এই মুহূর্তে এ বিতর্ক সৃষ্টির পায়তারা করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানতে হলে একটু পেছনে তাকাতে হবে। ঢাকাকে রাজধানী করে বাংলা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামের প্রদেশটি কার্যকর হয়। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষিত হয়।তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের সফরে ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ জন মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা সব দিক থেকে যে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ বিষয়টি জানিয়ে তারা আবার বঙ্গভঙ্গ চালুর দাবি জানান। না হয় এর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কমপক্ষে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দাবি করেন তারা।
জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন : The Government of India realised that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the Secretary of State for the constitution of University of Dacca. (বিএন কোরা)
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নাথান কমিশন গঠন করা হয়। নাথান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরে ইউরোপজুড়ে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। তখন ঢাকার প্রভাবশালী স্যার নওয়াব সলিমুল্লাহ নানাভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে চাপ দিয়ে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে তার মৃত্যুর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইংরেজ প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার কাজটি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তার ছেলে নওয়াব আলী চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীকে বারবার সামনে নিয়ে আসতে তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন নবাব সিরাজুল ইসলাম, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, আবদুল করিম, খানবাহাদুর আহছানউল্লা ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো নেতারা।
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে মধ্যবিত্তদের আর কষ্ট করে কলকাতায় গিয়ে পড়তে হবে না ভেবেই ঢাকার বালিয়াটির (মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া) জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে প্রচুর অর্থদান করেছিলেন। এ কারণে জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরী ঢাকা জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল, ১৮৬৮ সালে নাম বদলে জগন্নাথ স্কুল, ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ কলেজ এবং ২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। (সারাবাংলানেট)
এ লেখার সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক ২ জুলাই ২০২১ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মহোদয়ের প্রবন্ধ “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের লেখা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি।
“বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। পশ্চিম বাংলা ও বিহার অঞ্চলের কিছু মুসলমানও বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
তাঁদের যুক্তি ছিল ভিন্নতর। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁদের বা তাঁদের সন্তানসন্ততিদের কোনো কাজে আসবে না। যদি কোনো উপকার হয়, সেটা হবে পূর্ব বাংলার মানুষেরই। যে মুসলিম জনগোষ্ঠী এ রকম চিন্তা করত, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মৌলভি আবুল কাশেম, মৌলভি লিয়াকত হোসেন প্রমুখ। তদানীন্তন পূর্ব বাংলারও বেশ কিছু মুসলমানের মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস ছাত্র নেই, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে ওই টাকা দিয়ে পূর্ব বাংলায় আরও কিছু স্কুল ও কলেজ স্থাপন করলে এই অঞ্চলের মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগের পরিধিটা বাড়বে। তাঁরা আরও ভাবতেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য যে বাজেট সরকার থেকে আসে, তা অনেকাংশেই কমে যাবে। তবে নিঃসন্দেহে কলকাতার হিন্দু সমাজের কিছু লোক ছাড়া প্রায় সবাই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।”
“অতঃপর ১৯২০ সালে বঙ্গীয় আইনসভা বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তি লাভ করে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পাঠদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৮৭৭ জন ছাত্র এবং কলা, বিজ্ঞান ও আইন—এই ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে ছিল সূচনাপর্ব। প্রথম উপাচার্য ছিলেন মি. পি জে হার্টগ।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিময় পতিসরে তাঁকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট উপাধি প্রদানের সনদের যে প্রতিলিপি আছে, তার নিচে সনদ প্রদানকারী হিসেবে উপাচার্য স্যার এ এফ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথকে ডি-লিট উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্যার এ এফ রহমানের একক সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় যাঁদের সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে, তাঁদের মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ছিলেন নোবেলজয়ী।
এই সব তথ্য-উপাত্তের আলোকে এটা প্রমাণিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা তো করেনইনি, বরং এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর বন্ধন ছিল আমৃত্যু অটুট। (বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা।)
এবিষয়ে আমেরিকা প্রবাসী লেখক, গীতিকার, চিকিৎসা বিজ্ঞানী সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর সেজান মাহমুদ তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “সলিমুল্লাহ সাহেব নাকি ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন যার ওপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। সলিমুল্লাহ সাহেব প্রয়াত হলেন ১৯১৫ সালে, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো ১৯২১ সালে। তাহলে কি ওঁনার ভূত এসে দান করেছিল? পরিবার যদি করে থাকে তা তো ওনার দান না। তারমানে দিন দান করতেন না, তা কিন্তু বলিনি। যা সত্যদান সেটাই বলুন।
তিনি ওই স্ট্যাটাসে আরও লিখেন,”আমি নিজে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তাঁর নামকরণের ইতিহাস ঘেঁটে প্রবন্ধ লিখিয়েছিলাম কলেজ ম্যাগাজিনে। জনাব সলিমুল্লাহ দান করেছিলেন পাঁচ হাজার টাকা, রাণী দিনমণি পঞ্চাশ হাজার টাকা আর মিটফোর্ট দিয়েছিলেন তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়, জমি সব। তবু নামকরণ হলো নবাবের নামে, আর দিনমনির নাম প্রায় বিলুপ্ত! এই সত্যগুলো আপনারা জানেন?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান খান
নিউজবাংলাকে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘বলা হয়ে থাকে, নবাব সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দিয়েছেন। আমি নিজেই এটা নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি৷ কেউ কেউ বলেছে, কলকাতা কমিশন রিপোর্টের মধ্যে এটি উল্লেখ আছে। আমি সেই রিপোর্টটিও আদ্যোপান্ত দেখেছি। কোথাও এ ধরনের কোনো তথ্য নেই।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন সলিমুল্লাহ বেঁচেই ছিলেন না। জমি দান করার বিষয়টা একটা গল্প।’
পরিশেষে বলতে চাই, শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রহনন করা কোনো বাঙালির জন্যই শুভ নয়, কারণ বাংলাসাহিত্যে তাঁর অমর সৃষ্টি বাঙালি, বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে যে ঋণী করে গেছেন সে ঋণ কোনো কালেই শোধ হবার নয়! সত্য ইতিহাস না জেনে
মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানো কাম্য হতে পরে না।
৩ এপ্রিল ২০২৪
ডেট্রয়েট, মিশিগান, ইউএসএ
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
মন্তব্য করুন