মাহবুবুল আলম
অভিবাসী ভিসায় আমেরিকা এসেছি এক সপ্তাহ হয়ে গেল। আমাদের পিটিশনার ছিল মেঝ শ্যালক পরিসংখ্যানবিদ শিহাব চৌধুরী, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
JFK Airport এ আসার পর সে আমাদেরকে রিসিভ
করে। আমেরিকা আসার আগে অনেকের অনেক নেতিবাচক কথাবার্তায় ভেতরে ভেতরে কিছুটা শঙ্কায়
ছিলাম। কিন্তু শ্যালকের আন্তরিকতা অভ্যর্থনায়
নিমিষেই সেই শঙ্কা হাওয়ায় মিশে গেল। শিহাব নিজে
ড্রাইভ করে আমাদের তার ‘হলিজ’-এর বাসায় নিয়ে
এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ০৯:৪৫।
পুরো বাসাই খালি। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো
বাসাটি দেখেই মন জুড়িয়ে গেল। এন্টিক ফার্ণিচারে প্রতিটি ঘর ও লন সাজানো-গোছানো।
শ্যালকজায়া সৈয়দা সুলতানা লিপি তখন তার স্কুলে
বাচ্চারাও যার যার স্কুল ও কলেজে। শিহাব তাড়া দিল গোসল সেরে ব্রেকফাস্ট করতে। আমি বাথরুমে ঢুকলাম এবং অল্প সময়ের মধ্যে শীত-গরম পানিতে গোসল শেষ করে বেশ সতেজ হয়ে ওঠলাম। গোসলের পর প্রায় বিশ ঘন্টা বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে গেলাম।
নাস্তা সেরে শ্যালকবাবুর বিশাল পরিসরের বাসা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গাড়ির গ্যারেজ, সুবিশাল আঙ্গিনা
সামনে ফুল ও ফলের বাগান। গাছে অনেক সবুজ
আপেল ঝুলে আছে। আমার বেগম সাহেবাতো চমৎকার বাগানটি দেখে বিষ্ময়ে হতবাক। সেও একজন বাগানপ্রেমি। বাংলাদেশে তার ছাদবাগান দেখে এমন কেউ নেই যে প্রশংসা করেনি।
ভাই-বোন মিলে শশা, সাদা করলা, বিভিন্নজাতের
মরিচ, শিম, গোটা কয়েক আপেল, কিছু সব্জি নিয়ে
ঘরে ফিরলো। তারপর বিমানে না ঘুমানোর ঘুম পুষিয়ে নিতে দীর্ঘ ঘুম। বিকেলে শ্যালকজায়া বাসায় এসে আমাদের ঘুম ভাঙ্গালো তারপর লাঞ্চ সেরে আড্ডা ও গল্লবাজীতেই এলার্ম-ঘড়িতে বেজে ওঠে মাগরিবের আজান। আমেরিকায় শীত পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের অগ্রাহায়নের শেষ যেমন শীত অনেকটা এমনই শীত। বাংলাদেশের ভেপসা গরম থেকে হঠাৎ শীতের আবহাওয়ায় এসে খাপ খাওয়াতে সামান্য অসুবিধায় পড়তে হয়েছে বৈকি। রাতে কম্বল জড়িয়ে আরামদায়ক একঘুমে ফুটে ওঠলো ধলপহর।
এদিন শিহাব আমাদের দু’জনকে ইস্ট রিভারের
তীরে বেড়াতে নিয়ে গেল। ইস্ট রিভারের স্বচ্ছ জল, ওপারের ম্যানহাটনের নান্দনিক দৃশ্য দেখে সত্যি মুগ্ধ
হলাম। প্রথম দর্শনেই আমেরিকার প্রেমে পড়ে গেলাম।
নদী তীরের হিমেল বাতাসে গা কেমন শিরশির করে ওঠলো, তবু উপভোগ্য হয়ে ওঠলো ইস্ট রিভারের নৈসর্গিক দৃশ্য। বেড়ানো শেষে নদীর তীরেই বিশাল চেইনশপ ‘কসকো’তে শপিংয়ে অংশগ্রহণ করলাম। এত বিশাল চেইনশপ আমি আগে আর কখনো দেখিনি।
বলতে গেলে আমেরিকায় এখন আমাদের হানিমুন
প্রিরিয়ড চলছে। যেন শ্বশুর বাড়িতেই আছি। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম বেড়ানোর মধ্যেই আছি। ১৭ সেপ্টেম্বর রবিবার ছুটির দিনে শিহাব ও লিপি আমাদের নিয়ে বাসার অদূরেই ক্যানিংহাম পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। সুবিশাল ও বিন্যস্ত পার্কটি দেখে মন ভরে গেল। বেশি ভাল লেগেছে ছুটির দিনে পার্কে অর্গানিক পণ্যের মেলাটি।
১৮ তারিখ বিকেলে সেঝ শ্যালক শাহজালাল ব্যাংক
মৌলভীবাজার শাখার প্রাক্তন ম্যানেজার মেধাবী
ব্যাংকার সেলিমুজ্জামান চৌধুরী এসে আমাদেরকে
তার হিলসাইড এভিনিউর বাসায় নিয়ে গেল। শ্যালক
জায়া ডাঃ জিনিয়া চৌধুরী আমাদের অভ্যর্থনা জানালো শত ব্যস্ততার মাঝেও বিভিন্ন জায়গায় আমাদের বেড়াতে নিয়ে গেল। এদের বদৌলতে প্রথম সাবওয়েতে ভ্রমণ উপভোগ করলাম। পরদিন বিকেলে নিউইয়র্কের পর্যটন ‘হাব’ টাইমস স্কয়ারে পৌঁছে দ্রুপদী আলোর ঝর্ণাধারায় চক্ষু ছানাবড়া। এ যেন এক স্বপ্নের জগতে পরিভ্রমণ। যেদিকে চোখ যায় আলোর নাচন মোহমুগ্ধ করে রাখলো।
টাইম স্কয়ার হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের কেন্দ্রস্থলে ম্যানহাটনে অবস্থিত একটি সড়ক চত্বর। টাইমস স্কয়ার নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এটিকে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সড়ক সংযোগস্থল’ বলা হয়। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত পথচারী সংযোগস্থল এবং বিশ্ব বিনোদন শিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ট্রাভেললেইজার ম্যাগাজিন টাইমস স্কয়ারকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিদৃষ্ট পর্যটন স্থল হিসেবে অভিহিত করেছে। প্রতিদিন প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ টাইমস স্কয়ার দিয়ে যাতায়াত করে। এই এলাকাটি রঙ-বেরঙের বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জ্বা ও প্রোজ্জ্বল সাইনবোর্ডের কারণে বিখ্যাত। প্রতিবছর এখানে জাঁক জমকের সাথে খ্রিস্টীয় নিউইয়ার উদযাপিত হয়ে থাকে। (পরবর্তীতে আলাদাভাবে টাইম স্কয়ার নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে) রাত ৯টা পর্যন্ত টাইম স্কয়ারে আনন্দঘন সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে আসি।
যুক্তরাষ্ট্র আসার পর ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে প্রথম যার ফোন পাই তিনি হলেন ‘সাইদুর রব’ সাহেব। তিনি কয়েক যুগ ধরে আমেরিকার নিউইয়ার্কে আছেন। তিনি জানতে চান আমি কোথায় ওঠেছি। কুশলাদি বিনিময়ের পর আমরা কোথায় একবার মিট করতে পারি জানতে চান। পরে উভয়ের সময় সুযোগ মতো দেখার করার কথা বলে ফোন রেখে দিই। নিজের জন্মভূমি থেকে ১০ হাজার মাইল দূরের পরবাসে এসে একজন ফেসবুক বন্ধুর ফোনকল পেয়ে মনে হলো যেন মৌলভীবাজারেই বসে কথা বলছি।
সাঈদুর রব সাহেবরা আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। তিনি
আমেরিকায় জনপ্রিয় বাংলা সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’র সম্পাদক হিসেবে ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন এরপর বহুদিন পত্রিকাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে পত্রিকাটি সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ‘ঠিকানা’র প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক এম.এম শাহীন। তিনি মৌলভীবাজার-২ আসনের দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। জনাব এম.এম শাহীন সাঈদুর রব সাহেবের ছোট ভাই। তাদের পুরো পরিবারই নিউইয়র্কে বসবাস করেন। সাঈদুর রব সাহেব একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবেও কমিউনিতে পরিচিত। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।
তিনি একজন ক্রীড়াবিদও দেশের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করেছেন। সেই টান থেকেই
মৌলভীবাজার জেলার নিজ উপজেলায় ১০ একর
জায়গায় নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেছেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান “Mahemoni Art sports museum”।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ জনাব সাঈদুর রব ফোন করে জানতে চান আমি ফ্রি আছি কি-না। আমি হ্যাঁ সূচক
জবাব দিতেই বললেন,” ঠিক আছে, আপনি রেডি
হয়ে থাকবেন মাগরিবের পর আমি আসছি। আমি মাগরিবের নামাজ আদায় করে প্রস্তুত হয়ে রব সাহেবের অপেক্ষায় থাকলাম। যথাসময়ে ওনি এসে
কল করতেই আমি নিচে নেমে এলাম। সাঈদুর রব সাহেব সিটবেল্ট খুলে তার লেক্সাস থেকে নেমে আমাকে গাড়িতে তুলে নিলেন কয়েক মিনিট গাড়ি চালিয়ে প্রিমিয়ার সুইটের সামনে গাড়ি রেখে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।
সাঈদুর রব সাহেব ফেসবুক বন্ধু হলেও কোনোদিন
ওনার সাথে আমার দেখা বা সাক্ষাৎ হয়নি। প্রথম
দেখাতেই একজন মানুষ এত আপন হয়ে ওঠতে
পারে সাঈদুর রব সাহেবকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস
করবে না। ওনি ডিনারের আমন্ত্রণ জানালে বিনয়ের
সাথে আমি ‘না’ বলি। পরে স্নেকসের আর্ডার দিয়ে
আমাদের আলাপ শুরু হয়। আলাপচারিতায় মৌলভীবাজারের সামাজিক, রাজনীতি, অর্থনীতি
সাহিত্য, সংস্কৃতির বিষয়আশয় ওঠে আসে। বাদ যায়নি আমেরিকা তথা নিউইয়র্কে বাংলাসাহিত্য-সংস্কৃতিও। সব বিষয়েই আমাদের দ্বিধাবিভক্তি যে দেশগঠন ও উন্নয়নের অন্তরায় একথা তিনি আক্ষেপের সাথে বললেন। ওনার একথায় সায় দিতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করিনি।
আড্ডা শেষে রাত ৯ টার দিকে সাঈদুর রব সাহেব আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে বিদায় নেন। সাঈদুর রব সাহেবের নিখাঁদ
আন্তরিকতাপূর্ণ আপ্যায়ন কখনো ভুলবো না।
চলবে —-
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন