মাহবুবুল আলম।।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির সঙ্কট কাটিয়ে দেশ দেশ যখন কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখনই কুমিল্লায় কথিত কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের কিছু কিছু জায়গায় ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী দূর্গা পূজার মূর্তি ভাঙচুর, তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়াসহ সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঘন্য অপপ্রচার চালিয়ে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রতির দেশ আমাদের বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং আমারদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে বর্তমান সরকারের সুসম্পর্ককে নষ্ট করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠেছে চিহ্নিত ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী, তাদের দোসর ষড়যন্ত্রকারীরা।
এরই মধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ফেনী, সিলেট, মৌলভীবাজার মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে পূজামণ্ডপে হামলা ও সহিংসতার ঘটনার দাগ শুকাতে না শুকাতেই এই একই পুনরাবৃত্তিতে পুড়িয়ে দেয়া হলো রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর। লুট করা হয়েছে নগদ অর্থ স্বর্ণালঙ্কার, গরু-ছাগলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের যেসব বাড়িতে আগুন দিয়েছে এর মধ্যে আগুনে একেবারে পুড়ে গেছে ১৫টি পরিবারের ২১টি বাড়ির সবকিছু। সব মিলিয়ে গ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলাকারীরা গরু–ছাগল নিয়ে গেছে।
পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে শুরু সহিংসতা শুরুর পর গত কয়েকদিনে তা দেশে বিভিন্ন ছড়িয়ে পড়ে এবার ছড়ালো রংপুরেও। পীরগঞ্জের জেলেপল্লীতে লাগা আগুনের কয়েকটি ভিডিও রোববার মাঝরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিওতে অন্ধকারের মধ্যে গ্রাম থেকে লাল আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। এতে দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
এরই মধ্য ফেনীতে ঘটেছে আরও একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। ফেনী পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম রামপুর গ্রামের বাসিন্দা শিবির ক্যাডার লাবিব ১৭ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যায় ফেনীর বড় মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে তার দুই বন্ধু মুন্না ও সফীকে সঙ্গে নিয়ে এক বোতল পেট্রোলসহ কালী মন্দিরে যায়। সেখানে মন্দিরের পুরোহিতকে ব্যাপক মারধর ও মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, বলে লুঙ্গি পর, না হয় ধুতিকে লুঙ্গির মতো করে ঝুলিয়ে পর। এরপর তাকে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পড়তে বলে। যার ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এগুলো সবই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া রামু অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনার এপিঠ, ওপিঠ! তাও আবার আগের মতোই ফটোশপে এডিট করা ছবি দিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাত তুলে রাতারাতি গোটা একটি পাড়া, জনপদ এমনকি পুরো দেশেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো।
পত্রিকার খবরে জানা যায় ফেসবুকে কথিত একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে রংপুরে হিন্দুদের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে৷ শুক্রবার দুপুরে ঠাকুরপাড়া গ্রামে হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাট হয়েছে৷ এসময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় এক ব্যক্তি৷ এলাকাবাসীর মতে কয়েক দিন ধরে হামলার প্রস্তুতি নিয়ে শুক্রবার জুমার নামাজের পর লাঠিসোটা নিয়ে ৫ হাজারের বেশি মুসল্লি হামলা করে এবং লুটপাটের পর বাড়ি-ঘর ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে৷
এমতাবস্থায় দেশের প্রগতিশীল মানুষ, অসাম্প্রদায়িক সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। ঢাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ
শাহবাগ চত্তরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ ১৯ অক্টোবর ২০২১ সারা দেশে ‘সম্প্রীতি সমাবেশ ও শান্তি শোভাযাত্রা’ করবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো এবং দেশের সব জেলা, মহানগর, উপজেলায় ‘সম্প্রীতি সমাবেশ ও শান্তি শোভাযাত্রা’ আয়োজন করবে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন।
১৮ অক্টোবর ২০২১ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক জরুরি সভায় ১৯ অক্টোবর সারাদেশে সম্প্রীতি সমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । সভায় সভাপত্বিত করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত হন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তৎপরতা প্রতিরোধ করার নির্দেশনা দেন।
এখানে উল্লেখ্য যে,আওয়ামি লীগ সরকারের আমলেই সরকারকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে দেশের অগ্রগতি, স্থিতিশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী এমন হীন চেষ্টায় মেতে ওঠে; কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে এমন ঘটনার একটিও নজির নেই। এতেই স্পষ্ট কারা বার বার এমন ঘটনা ঘটায়। তাই এটা যে একটি চিহ্নিত মহলের কাজ তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু একটি চিহ্নিত মহল এই সম্প্রীতি নষ্ট করতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা পূজা মণ্ডপকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করেছে। তাই এবারের কুমিল্লার ঘটনা যে সুপরিকল্পিত একটি অপচেষ্টা ছিল তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একটি মহল ইচ্ছা করে এই কাজটা করেছে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা সৃষ্টি করার জন্য। এ অপশক্তিকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের অর্জিত সমৃদ্ধি ও সব আর্জন নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। তাই সম্মিলিত প্রতিরোধের এখনই মোক্ষম সময়।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক
মন্তব্য করুন