কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত বনের বাঘমারা ক্যাম্পের কাছে মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ড টানিয়ে ৫ একর জমি জায়গা দীর্ঘদিন ধরে দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বনের একেবারে ভেতরে ‘সোনার বাংলা এগ্রিকালচার ফার্ম, প্রোঃ মরহুম শুকুর মাহমুদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা (বীরপ্রতীক) এর নামে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের বিরুদ্ধে এই জায়গা দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাইনবোর্ড এর ঠিক পাশাপাশি চোখে পড়বে দুটি পাকা ও কাঁচা ঘর। যে ঘরের দেয়ালে আঁকা রয়েছে পবিত্র কাবা শরিফ ও আরবি হরফে কিছু লেখা। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে বনের জমি দখলে রাখার অভিযোগ উঠেছে। তবে ১৯৯২ সালে মারা যাওয়া সাইনবোর্ডে উল্লেখিত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদের ভাতিজি হিসেবে সেখানে বসবাস করছেন একজন নারী। ওই নারীর দাবি, বনের ৫ একর জায়গা তার প্রয়াত চাচা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বরাদ্দ পেয়েছেন। ঢাকায় বসবাসরত চাচাতো ভাই ও চাচি মাঝেমধ্যে সেখানে যান। তাদের অবর্তমানে তিনি ও তার মা-বোন সেখানে বসবাস করেন।
আরো পড়ুনঃ প্রধানমন্ত্রী দরিদ্র ও ভূমিহীন মানুষদের জমিসহ ঘর তৈরি করে দেওয়া বিশ্বে বিরল
তবে ওই নারী আরও জানান, তার বিয়ে হয়েছে ঢাকায় এবং স্বামী মাঝেমধ্যে লাউয়াছড়ার এই বনের ঘরে এসে তার সঙ্গে থাকেন। সাইনবোর্ডে কৃষি খামারের কথা উল্লেখ থাকলেও উল্লেখিত ৫ একর জমিতে তার কোনো নমুনা দেখা যায় না।
সংরক্ষিত বনের ভেতর এভাবে ঘর তৈরি করে বসবাস এবং কথিত কৃষি খামার করার অনুমতি কীভাবে পেলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নারী জানান, তারা সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন। এসব বিষয়ে তার চাচি ও চাচাতো ভাই ভালো বলতে পারেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১২৫০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের বাঘমারা ক্যাম্পের ভেতর ঘর তৈরি বা কৃষি খামার করার জন্য সরকার কোনো জায়গা স্থায়ী বরাদ্দ দেয়নি। আদালতও তাদের পক্ষে রায় দেয়নি। কিন্তু তারা জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংরক্ষিত এ বনের জায়গা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছেন। ১৯৮০ সালের ১১ জুলাই প্রধান বন সংরক্ষকের কাছে নিজেকে অসহায় যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধা দাবি করে লাউয়াছড়া বনের ৫ একর ভূমি কৃষিকাজের জন্য ইজারা নিতে আবেদন করেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদ। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক বিবেচনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৫ একর জায়গা কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য দেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করে বন বিভাগ। তবে এজন্য তার কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে ভাড়া আদায় করার কথা বলা হয়। কিন্তু ভাড়ায় কৃষিকাজের জন্য জমি বরাদ্দ নেওয়ার পরপরই সে বছরের ৪ নভেম্বর বন ও
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর নিজে কৃষিজমি পাহারা দেওয়ার জন্য একটি ঘর নির্মাণের আবেদন করেন শুকুর মাহমুদ। আবেদনের পর অনুমতি না পেলেও সেখানে ঘর তোলেন শুকুর মাহমুদ।
১৯৮৬ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বসবাসের জন্য সরকার ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয় শুকুর মাহমুদকে। তবে সরকারের কাছ থেকে ফ্ল্যাট পাওয়ার পরও লাউয়াছড়ার এ জমি তারা ছাড়তে চাননি। ১৯৯২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর
শুকুর মাহমুদ মারা যান। এরপর তার স্ত্রী রাবেয়া মাহমুদ ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর সন্তানদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন জানিয়ে তাদের নামে জমিটি ইজারা দেওয়ার জন্য ফের আবেদন করেন। তবে সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে
জমিটি বরাদ্দ বা ইজারা পাননি।
বন বিভাগের একটি চিঠির অনুলিপি থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১ জুন সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক মনোজ কান্তি রায় মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠিটি লেখেন। সেই চিঠির তথ্য অনুযায়ী, শুকুর মাহমুদ লাউয়াছড়ার ওই জমি নিজের দাবি করে বন বিভাগের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা চলাকালীন অবস্থায় তিনি মারা যান। বন বিভাগ তদন্ত করে ভাড়ায় দেওয়া ওই জমি ইজারার চুক্তি বাতিল এবং জমি ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
বন বিভাগ বরাদ্দ না দেওয়ার পরও লাউয়াছড়ার ওই জায়গা বন বিভাগ থেকে ইজারা নিয়েছেন বলে দাবি করছেন শুকুর মাহমুদের উত্তরসূরিরা। তবে তাদের ওই দাবিকে জালিয়াতি মনে করছে স্থানীয় বন বিভাগ। তাহলে শুকুর মাহমুদের
উত্তরসূরিদের এতদিন কেন বনের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি তা জানতে চাইলে বন বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাইরের সাইনবোর্ডে বীরপ্রতীক উল্লেখ এবং ঘরের দেয়ালে কাবা শরিফের ছবি আর্ট করে
জায়গা দখলে রাখা হয়েছে। এগুলো ভাঙা সেনসেটিভ ইস্যুতে পরিণত হতে পারে তাই ঝামেলায় কেউ যেতে চায়নি।’
কমলগঞ্জের মোকামটিলায় নিজস্ব জমি রয়েছে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদের স্ত্রী ও ছেলের। এছাড়া তারা বসবাস করেন ঢাকায়। লাউয়াছড়া বনের সাবেক রেঞ্জার মোনায়েম হোসেন বলেন, ‘সরকার প্রয়াত এ মুক্তিযোদ্ধার নামে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে ঢাকায়। তবুও তারা এ জায়গাটা দখল করে আছে যা অনৈতিক।
জালিয়াতির মাধ্যমে বনের জমি দখলে রাখার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী রাবেয়া মাহমুদ বলেন,‘এ জায়গা আমরা সরকার থেকে পেয়েছি। কিন্তু বন বিভাগ লকডাউনের সময় কিছু জায়গায় গাছের চারা লাগিয়ে ফেলছে। এই গাছ তুলে নিতে বাধ্য করব।’ অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন যে বসবাসের জন্য সরকারের কাছ থেকে তারা ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন। এছাড়া স্বামী মারা যাওয়ার পর তার দেবর এই জায়গা নিয়ে মামলা করেন, যদিও রায় তাদের পক্ষে যায়নি।
এদিকে লাউয়াছড়ার সংরক্ষিত বনের ভেতরে এভাবে দীর্ঘদিন ৫ একর জায়গা দখল করে রাখা সত্ত্বেও বন বিভাগের নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ
সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, ‘লাউয়াছড়ার মতো বনে যদি এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে জায়গা দখল করে রাখা হয় বন বিভাগের জানামতে, তাহলে সারা দেশে বনের জায়গার কী অবস্থা তা সহজেই বোঝা যায়।’ তিনি দ্রুত এ জমি উদ্ধার করে বনের রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘কোনো একসময় মানবিক কারণে তাকে (প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদ) ভাড়ার ভিত্তিতে বন বিভাগ কিছু জমি দিয়েছিল। কিন্তু তারা সেই শর্ত মানেনি, উল্টো মামলা করে। এখানে ঘর বানানোর অনুমতি প্রথম থেকেই ছিল না। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে বন বিভাগ যখন দেখল যে তারা জায়গাটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ১৯৯৬ সালে তাদের দেওয়া লিজ বাতিল করা হয়। এরপরও তারা এখানে
আছে।’ এ জায়গার বিষয়ে কী করা হবে তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। তবে এটা বলতে পারি যে বনের জায়গা কেউ দখলে রাখতে পারবে না এবং নিজের বলে দাবি করতে পারে না।
মন্তব্য করুন