লে. কর্ণেল (অব.) আবু ইউসুফ যোবায়ের উল্লাহ পিএসসি
১৯৭১ সাল আমাদের চেতনা আর ৫ আগস্ট ২০২৪ আমাদের অনুপ্রেরণা। দীর্ঘ ১৭ বৎসরের নির্যাতন, জনগণের হাহাকার আর আকুতি মিনতি সৃষ্টিকর্তার নজর কেড়েছিল। ইতিহাস জুড়ে সকল স্বৈরাচার যেভাবে সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল। আমাদের দেশের সর্বশেষ স্বৈরাচারেরও এহেন পতন অবধারিত ছিল এবং হয়েছে। অতীতের ফেরাউন, নমরূদের মতো হাসিনারও পতন হয়েছে তবে সে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তার পরামর্শদাতার দেশে। স্বৈরাচারী হাসিনা চরম নিষ্ঠুর ইসলাম বিদ্বেষী মোদীকে স্বামী হিসাবে স্বীকার করে সরকারিভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মন্ত্রীর মাধ্যমে পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক মিডিয়াতে ঘোষণা দিয়েছিল।
ভারতীয় বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান উপেন্দ্র ত্রিবেদী বলেন,- “প্রতিবেশীদের মধ্যে বিদ্বেষ কারো জন্যই ভাল না”। বিদ্বেষমূলক আচরণ যে খারাপ পরিণতি ডেকে আনে তা তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। আর আমরা গত ১৫ বৎসর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে বিভাজনের রাজনীতি করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও সাধারণ জনগণ একে অপরের প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টি করি। রাজনীতিতে এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ যে সার্বভৌমত্যের জন্য ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসে তা বর্তমান রাজনীতির অনেকেই হয়তো বুঝতে পারছেনা। আবার অনেকে বুঝেও না বুঝার ভান করছেন কিংবা যৌবনে হানি ট্র্যাপে ধরা খাওয়ায় বাধ্য হয়ে কিছু বয়োবৃদ্ধ নেতা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, বিভেদের রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরীতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছেন। ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে আমি বিষয়টি আপনাদের কাছে তুলে ধরবো। ড. মিজানুর রহমান আজহারী ওয়াজ/বক্তৃতায় যা-ই বলেন এর মধ্যে একবার বলেছেন,- “এক দল খেয়ে গেছে, অন্য দল খাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে”। সেই দলের জন্য এ একটি ভয়ংকর অপবাদ! যারা কিনা সত্যিই খাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। কারণ মিজানুর রহমান আজহারী অগ্রিম জনসাধারণকে জানিয়ে দিচ্ছেন দ্রুত নির্বাচনের পর ঐ বুভুক্ষু দল যা করতে চায়। আর আমরা যদি ঐ লুটপাটের উদ্দেশ্যে নির্বাচন না চাই, শুধুমাত্র দেশের উন্নয়নের জন্য চাই, তবে আজহারীর ঐ বক্তব্য আমাদের জন্য নয় এবং এতদ বিষয়ে উত্তেজিতও হওয়ার কথা না। কোন একটি দল ঐ বক্তব্যে এতই উত্তেজিত যে, আজহারীকে কোন ব্যক্তি যদি কেটে ১০ টুকরা করে আনতে পারে, তার জন্য ১০ লক্ষ টাকার পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এহেন আক্রমণাত্মক বক্তব্য নিশ্চয়ই দলীয় সিদ্ধান্ত নয়, তবে মাঠ গরম করা কিংবা সমর্থকদের উত্তেজিত করার জন্য যথেষ্ট। দলীয় নেতা/নেতৃত্বের সামান্য উত্তেজনা দলীয় কর্মীদের জন্য ভয়ংকর উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ভারতের বিজেপি নেতাদের মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যই, তাদের কর্মী কর্তৃক মুসলিমদের উপর চরম নির্যাতনের মূল কারণ। আমরা এদিক থেকে সৌভাগ্যবান। ইসলাম ধর্মে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কঠিনভাবে নির্দেশিত। এ কারণেই একজন মুসলমান নেতা যে দলেরই হোক না কেন, কোন পাবলিক মিটিং এ অন্য কোন ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পেশ করতে পারেনা। কারণ এটা আমাদের ধর্মেও নেই, আবার আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও নেই। এখন কথা হচ্ছে আমরা কেন আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিতর্ককে এক ভয়ংকর ব্লেইম গেইম কিংবা কাদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে নিয়ে এসেছি ? যা মাঝে মধ্যেই রাজপথে হানাহানির পর্যায়ে পৌঁছে? সভ্য দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা কখনও বিশ্রী কাদা ছোড়াছুড়ি কিংবা হানাহানি পর্যায়ে পৌঁছেনা কিন্তু মনে হয় আমাদের রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে, “হাত থাকতে মুখে কী কথা” গণতন্ত্র চর্চায় পৃথিবীর কোথাও হয়তো রামদা মিছিল হয়নি যা, আমাদের দেশে নির্বাচনের পূর্বে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে আয়োজন করা হয়। এ হচ্ছে অসুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা যা পশ্চিমা গণতন্ত্র ধারনাও করতে পারেনা। আমরা গণতন্ত্র বলতে এখন বুঝি ক্ষমতায় বসতে পারলে, ব্যাংকগুলোকে খালি করে নিজ বাসা গুলোকে টাকার গুদাম কিংবা স্বর্ণের গুদামে পরিণত করা। বিদেশে সম্পদের পাহাড় তৈরি করা।
দলীয় মন্ত্রী ও দেশের মন্ত্রী/প্রধানমন্ত্রী এর ভিতর অনেক বড় তফাৎ। যিনি স্পষ্ট এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাকে বুঝতে হবে তিনি তখন একটি দেশের মন্ত্রী/প্রধানমন্ত্রী, কোন দলের নয়। যখন তিনি দলীয় চেতনা থেকে মুক্ত হতে পারবেননা, তখনই তিনি ধাবিত হবেন স্বৈরাচারী মানসিকতার দিকে, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চিন্তা/চেতনা আর কর্মকাণ্ডে। প্রয়োজনে দেশের শত্রুদের সাথে গোপন সম্পর্ক স্থাপনেও কোন প্রকার দ্বিধা থাকেনা। কারণ তখন দেশ ও জনগণের স্বার্থ হয়ে যায় গৌণ, ব্যক্তি স্বার্থ আর দলীয় স্বার্থই হয়ে যায় মুখ্য। যা আমরা দেখতে পাই গত অনির্বাচিত/নির্বাচিত সরকারের মধ্যে।
এখন বিষয়টি হচ্ছে, আগে নির্বাচন তারপর সংস্কার ? না আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন ? বর্তমানে আমাদের দেশের প্রধান কোন দলীয় প্রধান নন। তিনি সরাসরি জনগণ কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত। এ কাজে পর্দার অন্তরালে কারা নিয়োজিত ছিল তা আমাদের জানার প্রয়োজন নেই। আমরা এখন চাই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি উনি পরিবর্তন করে তারপর নির্বাচন দিবেন। এক ভয়ানক বিস্ফোরণমুখ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমাজে চালু রেখে সকল নির্বাচনই হবে, ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন ফর নাথিং https://www.thedailystar.net/news-detail-27742। ক্ষমতায় ছিল এমন সব দলগুলোকে যদি প্রশ্ন করা হয় তাঁরা অতীতে সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েও কেন পরবর্তী নির্বাচনে ভরাডুবি ফল পেয়েছেন? সেই ব্যর্থতার কারণ সমূহের তালিকা কি আপনারা করেছেন ? সেই তালিকার কারণ সমূহের বিপরীতে কি কি পরিকল্পনা এবার করেছেন ? আপনাদের সেই পরিকল্পনা কোথায় ? আপনাদের উচিৎ অতীতের ব্যর্থতার কারন সমূহ এবং বর্তমান পরিকল্পনা জনগণকে অবগত করেই তাদের কাছে ভোটের আবেদন করা। একেই বলে জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র। অতীত ভুলের যে আর পুনরাবৃত্তি হবেনা তার গ্যারান্টি কোথায় ? আমরা নিশ্চিত যে সেই হিসাব নিকাশ দলীয়ভাবে এখনও করা হয়নি। অতীতের ভুলগুলোকে যদি আপনারা চিহ্নিত করতে না পারেন ভুল শুধরাবেন কি করে ? এহেন পরিস্থিতে দ্রুত নির্বাচন ঐ দুষ্ট সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। “Free and fare election for nothing”। এভাবেই আমরা স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছি বার বার।
আমাদের দেশকে ১ম বিশ্বে উন্নীত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন চেতনার সংস্কার। ইরান, আফগান, চীন, রাশিয়া এরা প্রচলিত গণতন্ত্র ফলো করেনা, এরা দ্রুতই উন্নত হচ্ছে। আবার পাশ্চাত্যের জনগণ গণতন্ত্র ফলো করে ওরাও দ্রুত উন্নত হচ্ছে। আসলে এখানে তন্ত্রমন্ত্র কিছুনা। বিষয়টা হচ্ছে জাতীয় চরিত্র ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেতনার মানদন্ডের উপর। উদাহরণ স্বরূপ জাপানের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। ২য় মহাযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত জাপান মাত্র ১০/১২ বৎসরে একটি উন্নত দেশে পরিনত হয়। কেন এবং কিভাবে ? তা বুঝতে পারলেই আমাদের সকল সমস্যার সমাধান। শুরুতেই চরিত্রের সংস্কার। এতদ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পরিকল্পনা কি ? বাস্তবতা হচ্ছে জনগণ ধারনা করে, এ ধরনের চেতনা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাঝে অনুপস্থিত। তাই এখন কোন ভাবেই নির্বাচন নয়, নির্বাচনের পূর্বে হবে জনমন থেকে দুর্নীতির ঘোড়ারোগ দূর করা এবং তারপর নির্বাচন। গত ৫৪ বৎসরের যে রোগকে নির্মূল না করে যারা বৃদ্ধি করেছে, কোন ভাবেই তাদের কাছে দেশের ভাগ্য হস্তান্তর করা যায়না। এতদ বিষয়ে দেশেই বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত, শুধু প্রয়োজন কানেক্টিভিটি এবং দায়িত্ব অর্পণ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
লেখক
দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ বিনির্মাণে অনন্য ফর্মূলার রূপকার ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি।
আপনার মতামত লিখুন :