মাহবুবুল আলম
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ৮ মাসেরমতো বাকি। এরই মধ্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের নীলনকশা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠী, আর সেই গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের ভূমিকায় সমানে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে সর্বাধিক প্রকাশনার তকমা লাগানো ট্রান্সকম গ্রুপের বাংলা প্রথম আলো ও’ দি ডেইলি স্টার।
পত্রিকা দুইটি মাঝে মাঝে এমনসব নেতিবাচক সংবাদ তৈরি করার চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষ যেন সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। যার পেছনে সমস্ত কলকাঠি নাড়ছে ১/১১’র কুশীলবরা।’ যে কোনো সরকারের দুঃশাসন, দুর্নীতি, অপশাসন ও স্বৈরাচারী মনোভাব দোষত্রুটি নিয়ে যে কোনো পত্রিকাই লিখতে পারে, এখানে দোষের কিছু নেই। বা একজন সরকার প্রধানকে কোনো কোনো পত্রিকা পছন্দ না করার কারণে সেই সরকার প্রধানের নানান দোষত্রুটি নিয়ে লিখতেই পারেন
এটাও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের কাজ হতে পারে;
তবে সরকার ও সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে লিখতে
গিয়ে যদি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার এজেন্ডা নিয়ে
মাঠে নামে সেটা অবশ্য বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার
পরিপন্থী, তা কোনো পত্রিকার চোখে আঙ্গুল দিয়ে
দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
আসুন একটু জেনে নিই হলুদ সাংবাদিকতা কাকে বলে। যেসব সাংবাদিক বা সংবাদপত্র উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনা করে তা ই হলো হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হল সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে বিচার বিশ্লেষণ না করে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানো। অর্থাৎ হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকৰ্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্ৰতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্ৰচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখন বেশ জোরেশোরে নানামুখী তৎপরতা চলছে। সুশীল সমাজ নামে পরিচিত একটি অংশ এখন জনগণকে বিভ্রান্ত করতে তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন। ১/১১ কুশীলবদের মাঠে নামানোর এক পরিকল্পিত অপপ্রয়াস চলছে। এ ভূমিকায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার এখন নগ্নভাবে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে । যার ন্যাক্কারজনক বহিঃপ্রকাশ সম্প্রতি প্রতিনিয়তই ঘটছে।
স্বাধীনতা দিবসের মত দিনে প্রথম আলো একটা
শিশু ছেলেকে ১০ টাকা ঘুষ দিয়ে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’। শিশুটির সরলতাকে ব্যবহার করে তার ছবি দিয়ে নিজেদের মনমতো ক্যাপশন করে স্বাধীনতার মূলে আঘাত করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছে তারা। আর ডেইলি স্টার বাংলা রিপোর্ট করছে, ‘ভোটের অধিকার নেই, স্বাধীনতা নেই, মানুষ ঠিকমতো খেতে পায় না’, এটি একজন দিনমজুর নাকি বলেছেন। তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘৩ দিন আগে পাঙ্গাস মাছের একটি পিস এবং দেড় প্লেট ভাত খেয়েছিলাম ৬০ টাকা দিয়ে এবং ৬ মাস হয়েছে মাংসের দিকে তাকাই না।” একই হাউজের এই দুটি পত্রিকার এমনসব রিপোর্টকে হলুদ সাংবাদিকতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? এই ধরণের সাংবাদিকতা শুধু সরকারের ভাবমূর্তিই নষ্ট করে না, বিশ্ব দরবারে দেশের উন্নয়নের সুনামকে ধূলোয মিশিয়ে দেয়ার অপতৎপরতা সাংবাদিকমহলকে কলঙ্কিত করেছে।
স্বাধীনতা দিবসের মতো বিশেষ দিনে কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ব করতে প্রথম আলো মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে এবং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে? বর্তমান সরকারকে প্রথম আলো এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্ন করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে?
প্রথম আলো ১/১১ পর থেকেই আওয়ামী লীগ
তথা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আধাজল খেয়ে লেগেছে
২০০৬ সালে সেনাশাসিত সরকার আসার পর প্রথম আলোর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থান পরিষ্কার হতে থাকে। তারা ইউনূসের সরকার দখলের ব্যর্থ চেষ্টায় সবসময় সমর্থন দিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে, পদ্মা সেতু হচ্ছে না বলে বেনার হেডলাইন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেশের মানুষসহ বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করেছে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সাহাব উদ্দিন চুপ্পুকে
প্রার্থিতা করা করা হলে “রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক পদবী কি-না প্রশ্ন তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল প্রথম আলো, অথচ প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে যখন রাষ্টপতি নির্বাচিত করে, রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক কি-না জানতে চেয়ে রিট করলে রিট বাতিল হয়ে যায়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক নয় বলে রায় প্রদান করে। এটা
জেনেশুনেও প্রথম আলো সাহাব উদ্দিন চুপ্পুর প্রার্থিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল।
১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিমিয়ে অর্জিত আমাদের গৌরবের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর এই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ন্যাক্কারজনক প্রতিবেদন জাতিসত্তা বিনাশী অপতৎপরতা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? স্বাধীনতা দিবস আমাদের কাছে অনন্য এক গৌরবময় দেশপ্রেম ও দেশাত্ববোধ সৃষ্টির দিন। অথচ এমন একটি দিনে এই সংবাদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা বা হেয় প্রতিপন্ন করার শামিল নয় কি?’
এবিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতু মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের ক্ষোভ প্রকাশ
করে বলেন- ‘ঐতিহ্যগতভাবে দৈনিকটি এক বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যে কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকে, তা হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ঘৃণা ছড়ানোর জন্য কুৎসামুলক সংবাদ পরিবেশন করে। তারা বরাবরই বিরাজনীতিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এভাবেই ঘুষ দিয়ে ব্রহ্মপুত্রপাড়ের চিলমারীর প্রতিবন্ধী নারী বাসন্তীকে ১৯৭৪ সালে ১০ টাকার শাড়ি খুলে ৩’শ টাকার জাল পরিয়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পটভূমি রচনা করা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রায় তিনদশক বাংলাদেশে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখা হয়েছিলো।’
এই সংবাদটি যে সর্বৈব মিথ্যা সেটি উন্মোচন করেছেন আইনজীবী ও সাংবাদিক নিঝুম মজুমদার। তার সাথে ভিডিওতে একাত্তর টিভির তুখোড় সাংবাদিক ফারজানা রূপাও ছিলেন। তারা সবুজ নামের সাত বছরের শিশুটিকে খুঁজে বের করেছেন যাকে প্রথম আলোর সাংবাদিক জাকির হোসেন নাম দিয়ে, পরিকল্পিতভাবে সাভারের স্মৃতি সৌধের গেটে ফুল হাতে দাঁড় করিয়ে একটি কাল্পনিক উদ্ধৃতি সাজিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। এই সংবাদ শুধুমাত্র তাদের অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছিল কিন্তু দেশের সচেতন মানুষ এই সংবাদের সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে তারা এর শিরোনাম পরবর্তীতে পাল্টে দেয়।
জাকির হোসেন নামে যে কেউ নেই, নিঝুম মজুমদার ও ফারজানা রূপা সবুজের বাসায় গিয়ে সবুজ ও তার মায়ের সাথে কথা বলে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তারা কথা বলেন পাড়া-প্রতিবেশীসহ অনেকের সাথে। তারা তার সরাসরি ভিডিও করে সেটি স্বচ্ছতার জন্য উন্মুক্তও করেছেন। সেখানে সবুজের মা তার ছেলেকে নিয়ে এ ধরনের সংবাদে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন যে তাদের সামর্থ অনুযায়ী তারা ভালো খাওয়া দাওয়া করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে সবুজের পক্ষে এই ধরণের বক্তব্য দেয়া যে অসম্ভব তা তার সাথে আলাপচারিতাতেই প্রকাশিত হয়। প্রথম আলো মূলত তার কাছে কোন বক্তব্যই চায়নি। তাকে দশ টাকা ও হাতে ফুল ধরিয়ে স্মৃতিসৌধের গেটে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে আনে। প্রথম আলোকে এ বিষয়ে একাত্তর টিভির পক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করলে তাদের পক্ষে সাজ্জাদ শরীফ জানান ছবিটি প্রকাশের ১৭ মিনিটের মাথায় তারা আবার সরিয়ে ফেলেন।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাতে দশম জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্য ও রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রথম আলো, ডেইলি স্টার আমি পড়ি না। বলেন, দু’টি পত্রিকা ২০ বছর ধরে আমার বিরুদ্ধে লিখে আসছে।… তিনি আরও বলেন, মিডিয়ার জন্য যত বেশি সুযোগ দিয়েছি, আমি তত বেশি ভিকটিম হয়েছি। দু’টি পত্রিকা আমার বিরুদ্ধে ২০ বছর ধরে লিখে আসছে। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পর থেকে এই দু’টি পত্রিকা আর পড়ি না। তিনি আরও যোগ করেন- `একটি পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বীকার করেছেন—ওয়ান-ইলেভেনের পর আমাকে দুর্নীতিবাজ বানাতে তার পত্রিকা যত কিছু লিখেছে সেগুলো নাকি ডিজিএফআই সাপ্লাই দিয়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে লেখা থাকে নির্ভীক সাংবাদিকতা। তবে তারা আলোর কথা বলে অন্ধকারের কাজ করে। এই লেখাগুলো ছাপাল; কিন্তু সূত্র লেখা হলো না কেন?`প্রধানমন্ত্রী বলেন, `ওয়ান-ইলেভেনে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকতে প্রথমেই আমার ওপর আঘাত আসে। আমি তো সরকারে ছিলাম না, বিরোধী দলে ছিলাম। তবে কেন প্রথমে আমাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাকে দুর্নীতিবাজ বানাতে ওই দুটি পত্রিকা একের পর এক মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে গেছে।…
পরিশেষে বলতে চাই, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার আগে একই রকম উদ্যোগ নিয়ে রংপুরের চিলমারীর প্রতিবন্ধী ও পাগল বাসন্তী নামের এক মেয়ের গায়ে মাছ ধরার জাল পরিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছিল ইত্তেফাকের সম্পাদক মঈনুল হোসেন ও এনায়েত উল্লাহ খানরা এতে সারা দুনিয়ায় বঙ্গবন্ধু সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণ ক্ষুন্ন হয়েছিলো তখন ছিল ইত্তেফাক ও হলিডে আর এখন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার একই খেলায় মেতে ওঠেছে।
প্রথম আলোর এই সংবাদটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে যা অনেকে এটি বিশ্বাস করেছে, এতে সরকারের সুনাম ভীষণ ক্ষুন্ন হয়েছে, তাই এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ যথাযথ বলেই আমি মনে করি। প্রথম আলোর মতো যারা হলুদ সাংবাদিকতা করে এদের পাঠকদের বয়কট করা উচিত। প্রথম আলো বারবার এই কাজ করে পার পেয়ে যায় কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না সেটাই বড় প্রশ্ন। সাংবাদিক ও সংবাদপত্র
হলেই তারা সকল অন্যায় এবং আইনের ঊর্ধ্বে তা হতে পারে না। এতে এরা নিজেদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবে অপরাধ, অপকর্ম ও অপপ্রচার করেও বেঁচে যায়। তা হতে পার না হতে দেয়া কোনোভাবেই উচিৎ নয়।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
[ ফুটনোট : প্রথম আলোর ফেইসবুক পেইজ এ কমেন্ট বক্সে যারা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বিরোধীতা করছে প্রথম আলো তাদেরকে ব্লক করে দিচ্ছে। এ কেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা? ফেসবুকের কবিবন্ধু আনিস আহমাদ ]
মন্তব্য করুন