আব্দুল কুদ্দুস, কুলাউড়া:
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার সংরক্ষিত পাথারিয়া রিজার্ভ ফরেস্টের লাঠিটিলা বনে প্রাকৃতিক গাছ-বাঁশ কেটে আকাশমণি গাছ রোপণ করে বনায়ন করছে বনবিভাগ। পরিবেশবাদীরা মনে করছেন- প্রাকৃতিক গাছ কেটে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আকাশমণি গাছ লাগানো বনায়ন লুঠপাটেরই অংশ। বনবিভাগের কর্মকর্তারা যেন সংরক্ষিত বন ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনে সিলেট বিভাগের পুনঃবনায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ‘উডলট বনায়ন’ এর আওতায় ১৫ হেক্টর জায়গাতে ৩৭৫০০টি গাছ লাগিয়েছে বনবিভাগ। প্রকল্পে চিক-রাশি, আকাশমণি, গামারি, কালোজাম, কদম, শিল কড়ই লাগানোর কথা থাকলেও শুধু আকাশমণি গাছ লাগানো হয়েছে। এখানকার বনায়নের জন্য প্রাকৃতিকভাবে বনে থাকা নানা জাতের উদ্ভিদ, বনের আদি গাছ এবং মুলি বাঁশ কাটা হয়েছে। একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বেলবাড়ী এলাকায় মোট ৬৫ হেক্টর বাগান করা হয়। এখানে ৪৫ হেক্টরই আকাশমণি এবং একই বিটের সমনভাগ বিট সংলগ্নে অবস্থিত বেকি হান্ডর এলাকায় উডলট বাগানে প্রায় ১৫ হেক্টর এবং সুফল প্রকল্পের আরও ১৫ হেক্টর জায়গাসহ ঐ বিটে মোট ৭৫ হেক্টর বাগান করা হয়েছে যার বেশীরভাগ আকাশমণি গাছ দিয়ে বাগান করা হয়েছে। তবে স্থানীয় সূত্রে পাওয়া এসব তথ্যের বিপরীতে বনবিভাগ কোন পরিসংখ্যান দিতে পারেনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সংরক্ষিত বনে গাছ লাগানোর জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পূর্বের প্রাকৃতিক লতাপাতা, উদ্ভিদ বন্যপ্রাণীর খাবার যোগান দেয় এমন ফলের গাছ এবং বাঁশ।
স্থানীয়রা আরো জানান, ন্যাচারাল বন ও সুরমা বাঁশমহালের লক্ষাধিক বাঁশ কেটে প্রথমে আগুনে পুড়িয়ে এখানে গাছ লাগানো হয়েছে। যেসব জায়গায় বনায়ন করা হয়েছে তার বেশীরভাগ ছিল আগে থেকেই ঘন বন। সেই সব প্রাকৃতিক বন নির্বিচারে উজাড় করে তা পুড়িয়ে গাছ লাগানো হয়েছে।
সংরক্ষিত বনের প্রাকৃতিক গাছ নষ্ট করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এভাবে বনায়নকে লুটপাটের অংশ এবং বন ধ্বংসের পায়তারা বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। খোদ বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এটা খুবই খারাপ কাজ হয়েছে। আকাশমণি লাগাতে আপত্তি নাই তবে মৌখিকভাবে বলা ছিল যেন ২০ শতাংশের বেশী না হয়। আকাশমণি গাছে পাখিরা বসেনা। অন্য প্রাণীরাও আসেনা। একটি সমৃদ্ধ বনের গাছ কেটে এভাবে বনায়ন করার কারণে বন্যপ্রাণীদের ক্ষতি হল। এখানে যেসব বন্যপ্রাণী থাকত তারা অন্যত্র চলে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মুনতাসির আকাশ জানান, এভাবে বনের আদিগাছ-বাঁশ কেটে বনায়ন করলে প্রাণীদের আবাস্থল নষ্ট হয়। বিশেষ করে বাঘ-ভাল্লুক, মার্টিনসহ বেশ কিছু প্রাণী আছে যারা এখন প্রায় বিপন্নের কাছাকাছি। এরা ছাড়াও এখানে অনেক সরিসৃপের বাসস্থান থাকতে পারে। সংরক্ষিত বনে যদি তাদের আবাস ঠিক না থাকে তাহলে এসব প্রাণী বিপন্ন হয়ে যাবে।
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, বনায়ন করতে গিয়ে সংরক্ষিত এই বনের প্রচুর গাছ কাটা হয়েছে। সবচেয়ে বেশী বাঁশ কাটা হয়েছে সুরমা ও হলম্পা বাঁশমহালে। এখানে এত ঘন বাঁশবন ছিল যে; ভেতরে ঢুকা যেত না কিন্তু কেটে পুড়িয়ে ছাইয়ের স্তুপ বানানো হয় এবং পরে সেখানে গাছের চারা লাগানো হয়। স্থানীয় গ্রামের জামাল মিয়া জানান, এখানে বনের গাছ বাঁশ কেটে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবে গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নিয়েছিল। এত বাঁশ কাটা হয়েছে যার বাজারদর কয়েক লক্ষ টাকা হবে। লাঠিটিলা বনের হায়াছড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান, আগে এখানে প্রচুর পাখি বসত এখন আকাশমণি গাছ লাগানোর কারণে পাখি আসেনা।
বনবিভাগের জুড়ী রেঞ্জার মো. আলাউদ্দিন জানান, ২০-২১ অর্থবছরে সুফলসহ বিভিন্ন প্রজেক্টের অধীনে এখানে বনায়ন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও কিছু বনায়ন করা হবে। আকাশমণি গাছের ব্যাপারে তিনি বলেন- শুধু আকাশমণি না সব ধরণের গাছ লাগানো হয়েছে। বনায়ন করতে গিয়ে সংরক্ষিত বন এভাবে ধ্বংস করতে পারেন কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা বাঁশ-গাছ তেমন কাটিনি; কিছু ঝোঁপঝাড় কেটেছি। আমরা মূলত বনের খালি জায়গায় বনায়ন করেছি। স্থানীয়রা অহেতুক বাড়িয়ে মিডিয়ায় বক্তব্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপার) কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম জানান, বনবিভাগের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বেশীরভাগ কর্মচারী কর্মকর্তা বনবিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। লাঠিটিলা একটি সমৃদ্ধ ও সংরক্ষিত বন। এই বনের প্রাকৃতিক গাছ বাঁশ কেটে বনায়ন করার কি প্রয়োজন? সুফলসহ বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে বনবিভাগ যত আগ্রহী তার ১ শতাংশ যদি বন রক্ষার প্রতি থাকত তবুও কিছুটা সান্তনা মিলত। সংরক্ষিত বনে বনায়ন করা যাবেনা এবং একটি লতাও কাটার কোন নিয়ম নেই।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তৌফিকুল ইসলাম জানান, আমি নতুন যোগাদান করেছি তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিনা। তবে এভাবে বন ধ্বংস করে বনায়ন করার যুক্তি নেই। আমি খোঁজ নিয়ে ঘটনা সত্য হলে এবং বনবিরোধী কিছু হলে ব্যবস্থা নেব।
মন্তব্য করুন