নজরুল ইসলাম ll
অদ্য নড়াইলের লোহাগড়ায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিরোধের জেরে ফল ব্যবসায়ী ও যুবলীগ কর্মী পলাশ মাহমুদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইউপি নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। নিহত পলাশের মা পলি বেগম বাদী হয়ে লোহাগড়া থানায় এ মামলা করেন। এটা মাত্র একটি ঘটনা। বিচ্ছিন্নভাবে সারাদেশে এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। ইউনিয়ন নির্বাচন হয়ে উঠেছে সংঘাত-সংঘর্ষের এক রণক্ষেত্র। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতন মহলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন কি তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে?
পাঠক, ইউপি নির্বাচন হল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। তৃণমূল পর্যায়ে সুষম বণ্টন উন্নয়ন আর গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সঠিক সেবাটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইউপি নির্বাচন যুগ যুগ ধরে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সত্যিকারের যথাযথ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্থানীয় তৃণমূল উন্নয়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত হয়।
পাঠক, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটা ইতিহাস আছে। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশের সময়ে চৌকিদারি আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রথম স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছিল। স্থানীয় সরকারের এ প্রাথমিক স্তরটি খুবই প্রাচীন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তার রচিত ও প্রদত্ত শাসনতন্ত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের দিয়েই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ গঠন করেছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ হাজার করে সর্বমোট ৮০ হাজার সদস্য নির্বাচিত হতো প্রত্যক্ষ ভোটে। তারাই ভোট দিয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, প্রাদেশিক সংসদের সদস্য, জাতীয় সংসদের সদস্য ও রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতেন। এ প্রথাকে বেসিক ডেমোক্র্যাসি প্রথা বলা হতো।
দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলমান। স্থানীয় সরকারের স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করায় সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতি কতটা কলুষিত হয়ে উঠেছে সেটার উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে। বিরুদ্ধ দলের সঙ্গে সংঘর্ষের চেয়ে নিজ দলের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সঙ্গে হানাহানি করছে। গত এক দশক ধরে বিএনপি যেহেতু মাঠে প্রায় বিলুপ্ত, আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ-ই চোখে পড়ছে সারা দেশে। বসুরহাট পৌরসভার মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই মাস ধরে সেখানে উত্তেজনা চলছিল। নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের একমাস পরে এসেও সংঘর্ষ থামেনি। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে লাশ পড়েছে একজন সাংবাদিকের।
পাঠক, যে কোনো দলের প্রতীক ও প্রার্থী নিশ্চিত করতে পারলেই বিজয় নিশ্চিত এটা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অশনি সংকেত। এমন চিন্তা এবং মনোবৃত্তি অগণতান্ত্রিক। স্থানীয় সরকার নির্বাচন উন্মুক্তভাবে হওয়ার ধারা ভেঙে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন সংক্রান্ত পাঁচটি আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মতো তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনেও রাজনীতি ঢুকে যাওয়ায় সমাজচিত্র আমূল বদল হয়ে গেছে। আগে নির্বাচনে আসতো সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, এখন সেখানে অনেকেই আসছেনা। আর যারা আসছে তাদের বেশিরভাগের না আছে সমাজ নিয়ে চিন্তা, না আছে গ্রহণযোগ্যতা। দলীয় প্রতীকে ভর করে নির্বাচিত হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে আখের গোছানোর চেষ্টা সিংহভাগের।
মানুষ আগের থেকে রাজনীতির সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত সে কারণে দলীয় প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তার হাতে বিকল্প প্রার্থী নেই। গণ্যমান্য, প্রভাবশালী, ভদ্রলোকেরা স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছে না।কোনও রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ডের পক্ষেই সম্ভব না কোনও একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঠিক করে দেওয়া। ফলে দলের কাউন্সিলরদের ভোট কেনাবেচায় ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থী ঠিক হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। দলের মধ্যে যোগ্য প্রার্থী ও দলীয় রাজনীতির এই নোংরা প্রতিযোগিতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের প্রাচীন একটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে বিষয়টি নিয়ে।
বর্তমান সময়ে সিংহভাগ চেয়ারম্যানদের যোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা এমন তলানিতে এসেছে যে স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে করোনাকালে। ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে সব স্থানে এখন আমলারাই এসব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের থেকে ক্ষমতাবান। অথচ স্থানীয় সরকারের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সুদীর্ঘ। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কথায় সমাজ চলতো। সিংহভাগ বিচার-আচার থানায় যাওয়ার আগে ইউনিয়ন পরিষদে শেষ হয়ে যেত। দৃষ্টিকটু হয়েছে ভোটের হিসাব কষে গ্রাম আদালতে ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যানরা দম বন্ধ করে বসে থাকেন। দুই পক্ষকে খুশী করার একটি ধান্দা সবসময় দৃষ্টিকটু হয়।
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রচনা করে। এই শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে নব-প্রণীত শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে সব স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ছিল। কোনও সময়েই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলভিত্তিক হয়নি।
আগে সমাজে কিছু শক্তিশালী লোকের বিচক্ষণ ছিল। তারাই সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করতেন। তাদের বেশিরভাগ লোক নির্দলীয় ছিলেন। চৌকিদার/দফাদার ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা দেখাশোনা করার জন্য কোনও লোক ছিল না। এমন সব শক্তিশালী লোকদের কারণে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকতো।
পাঠক, সমাজের সংহতি যেটুকু অবশিষ্ট ছিল বর্তমান সময়ে সেটাও শেষ। আগে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের, এক বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ির বিরোধ ছিল। এখন ঘরে ঘরে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ শুরু হয়েছে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কঠিন। প্রায়ই মনের মধ্যে প্রশ্ন উঁকি দেয় নির্বাচন আসলে কেন আমরা এতটা বেসামাল হই? মসজিদ মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা যেসব জনপ্রতিনিধিরা আত্মসাৎ করে খেয়ে ফেলে তাদেরকে আমরা আবারও বলছি- বল্টু ভাই এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার পিছে। সামগ্রিক চিত্র বড়ই উদ্বেগের। এর থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
আসুন একজন সৎ, যোগ্য, ন্যায়পরায়ণ যথাযথ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে আপনার আমার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করি। সে যে দলেরই হোক না কেন।
লেখক: জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস (এনএইচএস), লন্ডন
মন্তব্য করুন