মাহবুবুল আলম
বিশ্বের পরাশক্তি এবং স্বপ্নের আমেরিকায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও যুগ যুগ ধরে আমেরিকার অভিবাসী হয়ে এসে আমেরিকার পঞ্চাশটি স্টেটের বিভিন্ন সিটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়েআছে। নিউইয়র্কের পরে অভিবাসী বাংলাদেশিদের পছন্দের স্টেট হলো মিশিগান।
এখানে চাকুরির সহজলভ্যতাজীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম বলেই নতুন অভিবাসীরা এখানে এসে বসবাসকেঅগ্রাধিকার
দিচ্ছে। আর পুরনো অভিভাসীরা চাকুরি এবংব্যবসা-বাণিজ্যে দিন দিন সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেচলেছেন। একই সাথে এখানে বাংলাদেশের অভিবাসীদের সন্তানরা লেখা-পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডেও এগিয়ে আছেন।
তাছাড়া মিশিগানের চাকুরীক্ষেত্রে কর্পোরেট জব বা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি/ফ্যাক্টরি এবং শ্রমবাজারে দক্ষ, মেধাবী ও পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে বাংলাদেশিরা পরিচিতি লাভ করেছে।
বিভিন্নসূত্রে জানা গেছে, এখানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের আগমন শুরু হয় প্রায় চার দশকের বেশি সময় আগে। বর্তমানে মিশিগানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। যা ইতোমধ্যে লক্ষাধিকের কোটা ছূঁয়েছে। এখানে সিটিজেন, ইমিগ্রেন্ট ও নন-ইমিগ্রেন মানুষ বসবাস করে আসছে। তাই চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-যাপনের খরচ সবদিক বিবেচনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিশিগান রাজ্যে বাংলাদেশিদের আগমন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
মিশিগানের রাজ্যের ডেট্রয়েট এবং এর আশপাশের হ্যামট্র্যামিক, ওয়ারেন, স্টারলিং হাইটস, ট্রয়, রচেস্টার, রচেস্টার হিলস, টেইলর, সাউথগেট, এন আরবার, ফ্লিন্ট, ল্যান্সিং, শাগিনাও, গ্রান্ড রাপিড ও বে সিটির প্রায় সবখানেই রয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটি।
বিশেষ করে হ্যামট্রামিকের কথা না বললেই নয়। হ্যামট্রামিক যেন মিনি এক বাংলাদেশে এখানে বিপুল সংখ্যক লাদেশিদের বসবাস। ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বাঙালি ঐতিহ্য বিবেচনায় প্রথমে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। তাছাড়া এখানের কমিউনিটির বাংলাদেশিদের মধ্যকার সম্পর্কও অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সৌহার্দ্যএবং আন্তরিকতাপূর্ণ একজনের বিপদে-আপদে অন্যরাও পাশে এসে দাঁড়ায়।
মিশিগান অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহর ডেট্রয়েটের পাশের শহর হ্যামট্রামি; এখানে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অভিবাসীদের বসবাসের কারণে স্থানীয় নির্বাচনেও সাফল্য অনেক। এ কমিউনিটিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ও ঐক্যের কারণে বর্তমানে কাউন্সিল সদস্যের ছয়জনের মধ্যে তিনজনই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। হ্যামট্রামিকে বাংলাদেশিদের মতো পোল্যান্ড ও ইয়েমেনের অভিবাসীদের সংখ্যাও অনেক। তবে তাবাংলাদেশিদের চেয়ে খুব বেশি নয়। এর প্রমাণস্থানীয় কাউন্সিলর নির্বাচনে বাংলাদেশিদের সংখ্যাগড়িষ্টতা। অনেকেই মনে করেন এখানে এককপ্রার্থী দিতে পারলে মেয়র নির্বাচনেও জিতে আসাওঅসম্ভব নয়।
বাংলাদেশ থেকে মিশিগানের দূরত্ব কয়েক হাজার মাইলের ব্যবধান হলেও হ্যামট্র্যামাক শহরে এলে দুরত্বের ব্যবধান বুঝে ওঠা কঠিন। এখানে রয়েছে বাংলাদেশি খাবারের রেস্টুরেন্ট, মনোহারি দোকান তেমনি আছে মসজিদ, হাফেজি মাদরাসা, মন্দির, স্কুল, ড্রাইভিং স্কুলসহ অনেককিছু। এ অঞ্চলের ১০টি মসজিদের সাতটির তত্ত্বাবধায়নে রয়েছেন আমাদের বাংলাদেশিরা।
গত বছর মিশিগানের গভর্নর রিক স্নাইডার শহরটিকে ‘বাংলা টাউন’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
হ্যামট্রামিকের প্রবেশদ্বারে বাংলায় লেখা ” বাংলাটাউন”প্রস্তরটি ফলকটি মাথা উঁচু করে মিনি বাংলাদেশের পরিচিতি সগৌরবে বাংলাদেশের তুলে ধরছে। এখানে শহরের কনান্ট স্টিটের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’ নামে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এ শহরের নির্বাচনের ব্যালট পেপার ছাপা হয় বাংলায়।
মিশিগানের ওয়ারেন কাছাকাছি দুই শহর স্টারলিং হাইটস ও ট্রয় শহরেও রয়েছে বাংলাদেশিদের বড় কমিউনিটি। আমেরিকাতে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি এখানেই। এছাড়াও বেশ কিছু বাংলাদেশি চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীদের বসবাসও এখানে। সেইসঙ্গে রয়েছে বাংলাস্কুল ও প্রকৌশলীদের সংগঠন।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিপুল সংখ্যক মানুষ ওয়ারেনে বসবাস করে। বিশ্বখ্যাত জেনারেল মোটরসের ওয়ার্ল্ড টেকনিকেল সেন্টার এই শহরে অবস্থিত। এই সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশি প্রকৌশলীর সংখ্যা শতাধিক। এখানে গড়ে ওঠেছে যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী এবং তারা বাংলাদেশি অভিবাসী।
তবে এ শহরে বাড়ি ভাড়া ও ক্রয়মূল্য বেশ উচ্চহারের। তা সত্ত্বেও এখানে সম্প্রতি বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ট্রয় শহরে বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধায়নে মসজিদ রয়েছে। উন্নত স্কুল ব্যবস্থাপনার কারণে এই শহর বাংলাদেশিদের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে রয়েছে।
রচেস্টার ও রচেস্টার হিলস সিটিতেও বাংলাদেশিদের বসবাস বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। এ শহরে অধিকাংশ বাংলাদেশি গাড়ি নির্মাণ ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কর্ম
রত। তবে রয়েছে বেশকিছু চিকিৎসক ও ব্যবসায়ী পরিবারও। এখানে রয়েছে বাংলাদেশি হালাল মাংস ও খাবারের দোকান এবং বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে মসজিদ।
গ্রেটার ডেট্রয়েটের পশ্চিম প্রান্তের শহর ফারমিংটন, ফারমিংটন হিলস, নোভাই ও নর্থভিল শহরেও বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের একটি বড় অংশের বসবাস।
এসব জায়গায়ও রয়েছে অনেক দেশি খাবারের রেস্টুরেন্ট, যেগুলোর অধিকাংশ বাবুর্চি বাংলাদেশি।
এশহরগুলোতে মসজিদ ও মন্দির ছাড়াও রয়েছে বেশ উন্নতমানের স্কুল। এ শহরগুলোতে বেশকিছু দেশীয় মনোহরি দোকান রয়েছে। বাংলাদেশে প্রস্তুত প্রায়
সব ধরণের পন্যই এখানের গ্রোসারি শপগুলোতে
পাওয়া যায়।
মিশিগানে বাংলাদেশিদের অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে রয়েছে প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেকচার (আবিয়া)’, চিকিৎসকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা’, ইমামদের সংগঠন ‘ইমাম সমিতি’ এবং অনেক উপজেলা ও জেলা সমিতি। এছাড়াও মিশিগানে বাংলাদেশের বড় সব রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন রয়েছে। মিশিগানের প্রবাসী বাংলাদেশি ও সেখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেকের ধারণা অস্পষ্ট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মিশিগানেও রয়েছে সব রকম নাগরিক সুবিধা, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুযোগ। যার সবকিছুতেই মেলে নিখাদ বাংলাদেশি সমাজের বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশ অর্থনীতিতে মিশিগানের বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবদান কম নয়। মিশিগানের অগ্রসরসংবাদপত্র ‘বাংলা সংবাদ’ এর তথ্যমতে প্রতিমাসেএখান থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স যায়বাংলাদেশে। যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিশেষভূমিকা রাখছে। মিশিগানে বাংলাদেশি অভিবাসী বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে রেমিটেন্সপাঠানোর হার আরো বৃদ্ধি পাবে একথা অনেকটাইজোর দিয়ে বলা যায়।
তাছাড়াও বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিকাশেও দেশের মতোই মিশিগানের বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মন ও মননে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে লালন করে বাংলা নববর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বাংলাদেশের সব জাতীয় দিবস স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে থাকেন মিশিগানের অভিবাসী বাংলাদেশিরা। ল্যান্সিং মিশিগান অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। এখানকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছেন জনাবিশেক বাংলাদেশি ছাত্র। এছাড়া ল্যান্সিং, মেসন, হল্ট শহরে বাংলাদেশি অভিবাসী বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে।
যাক, পরিশেষে এই বলেই শেষ করতে চাই যে,উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে অভিবাসী হলেও দেশেরজন্য সবারই মন পোড়ে। বাংলাদেশের ভালো সংবাদে তারা যেমন উচ্ছ্বসিত হন তেমনি খারাপ সংবাদে সবারই হৃদয় কাঁদে। তাই প্রাকৃতিক নানান দৈব দুর্বিপাকে মিশিগানের বাংলাদেশের অভিবাসীরা তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন। এখানে দুস্থ বাংলাদেশি কোনো অভিবাসীর মৃত্যু হলে দাফন কাফনের জন্য সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নতুন অভিবাসীদের চাকুরি পেতেও সবাই সহযোগিতার হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে মিশিগানের বাংলাদেশি অভিবাসীরা সবাই বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।
[ তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল, সংবাদপত্র ও নিউজপোর্টাল ]
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মিশিগান, ইউএসএ
মন্তব্য করুন