মাহবুবুল আলম
প্রিয় ইসলামপ্রিয় ভাই ও বোনেরা, সারাজাহানের মুসলমান ভাই ও বোনেরা। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ্। মহান আল্লাহপাক আমাদের জন্য রহমত-বরকতের মাস রমজান উপহার দিয়েছেন সেই পবিত্র রমজান মাস প্রায় শেষ হতে
চললো। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে দুইদিন পরই পবিত্র শব ই কদর বা সৌভাগ্যের রজনী শব ই পালিত হতে যাচ্ছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে শব ই কদর এর মহিমান্বিত রাত পালনের তৌফিক দান করুন।
আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ বা কদর রজনী, এর ফারসি হলো শবে কদর। অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত,সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী। যে রাতে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন নাজিল হয়েছে, সে রাতই হলো লাইলাতুল কদরেরর রাত বা সৌভাগ্যের রজনী। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন: ” নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে সমভিব্যহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা বা ফজর পর্যন্ত।” (আল কুরআন, সুরা-৯৭ [২৫] আল কদর)পবিত্র রমজানের শেষ ১০ দিনের যে কোনো বেজাড় চান্দ্র তারিখে শব ই কদর সন্ধান করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন। তিনি বলেছেন “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর সন্ধান করো।’ (মুসলিম)। এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়। অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ রমজান দিবাগত রাত্রসমূহ। সর্বোত্তম বিবেচনায় আমাদের বাংলাদেশে ২৬ রোজার রাতে অর্থাৎ ২৭ রমজানে পবিত্র শব ই কদর পালিত হয়ে আসছে।
ইসলাম ধর্মমতে, এ রাতে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর অনুসারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তাই মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল কদর মুসলমানদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে।
বিশ্বের সকল মুসলিম নারী-পুরুষ রমজানের রোজা রাখার মাধ্যমে এ রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাই ইসলামে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। রোজাদার মুসলমানা এ রাতকে পেয়ে নিজেকে আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন। আল্ কোরআনে লাইলাতুল কদরের অনন্য মর্যাদায় একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা রয়েছে। এ সূরা থেকে এর গুরুত্ব অনুভব করা যায়। এ রাতে কালামে রব্বানী নাজিল হয়। এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।
যে ব্যক্তি এ রাতে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে মহান আল্লাহতায়ালা তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে।” (বুখারি)। অন্য এক হাদিসে আছে, “রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাযা) এ রাতকে লাইলাতুল তাকদীর বা ভাগ্য নির্ধারণের রাতও বলা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, “লাইলাতুল কদরে মানুষের জীবনকাল, মৃত্যু, রিজিক এবং বৃষ্টিপাত নির্ধারিত হয়ে থাকে।
তাই বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বরকতময় রাত হলো শবে কদর। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার জাবালে রহমত তথা হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.)–এর মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি পবিত্র কোরআন অবতীর্ণশুরু হয়।
এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এ রাতের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ রাতে মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদিকে হাজার মাসের ইবাদত-বন্দেগি ও আমলের সমান সাওয়াব দান করে। কুরআনুল কারিমের অন্য স্থানে এ রাতটিকে বরকতময় রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। লাইলাতুল কদরের মর্যাদা এত বেশি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতটি পাওয়ার জন্য শেষ দশকে আজীবন ইতেকাফ করেছেন।
উম্মতে মুহাম্মদীর উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে (রমজানের) প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। তারপর আমার প্রতি ওহি নাযিল করে জানানো হলো যে, তা শেষ ১০ দিনে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে।
মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হওয়ার কারণে অন্যসব মাসের চেয়ে রমজান মাস বেশি ফজিলত ও বরকতের মাস। আর রমজানের রাতগুলোর মধ্যে কোরআন নাযিলের রাত লাইলাতুল ক্বদর সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত একটি রাত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি একে নাযিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জান ক্বদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (সূরা: কদর, আয়াত: ১-৩)।
আসুন প্রিয় ইসলামপ্রিয় বন্ধুরা শবে কদরের তিনটি রাতের সাধারণ আমল করি। যারা এই আমল
করবে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহপাকের অসীম সওয়াব নেয়ামত ও বরকত।
১- আল্লামা মাজলেসি (রহ) শবেকদরের আমল সম্পর্কে বলেছেন-সর্বপ্রথম যে আমলটি এই রাতের সূচনায় করা উচিত তাহলো-গোসল করা। তিনি গোসল করে মাগরিবের নামায আদায় করার কথা বলেছেন। এটা আসলে পবিত্রতা অর্জন করে রাতের ইবাদাতের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যেই হয়তো গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুসলমানরা তো এমনিতেই নামায পড়ার আগে অজু করে পবিত্রতা অর্জন করে থাকেন। কিন্তু গোসল করা হলে পবিত্রতার পাশাপাশি শারিরীক-মানসিক উভয় প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে যায়। গোসল করলে একটা প্রশান্তি এবং প্রফুল্ল ভাব আসে, ক্লান্তি-শ্রান্তি দূর হয়ে যায়, তাই ইবাদাতে ভালোভাবে মনোনিবেশ করা যায়। গোসল করাটা তাই ভালো একটি আমল।
২- দ্বিতীয় যে আমলটির ওপর আল্লামা মাজলেসি জোর দিয়েছেন তা হলো মাগরিবের নামাযের পর দুই রাকাত নামায পড়া। প্রতি রাকাতে হামদ ও সানার পর সাতবার করে সূরা তৌহিদ পড়ার কথা বলেছেন তিনি। সূরা তৌহিদ হলো কুল হুয়াল্লাহু আহাদ…এই সূরাটি। এভাবে দুই রাকাত নামায পড়ার পর সত্তুর বার আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিং কুল্লি জাম্বিউঁ অ-আতুবু ইলাইহি….পড়ার কথা বলেছেন। এভাবে যিনি নামায পড়বেন এবং ইস্তিগফার করবেন তিনি ঐ স্থান ত্যাগ করার আগেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতার ওপর রহমত বর্ষণ করবেন।
৩- আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ আমলের কথা তিনি বলেছেন তাহলো কোরআন তেলাওয়াৎ করা এবং দোয়া পড়া । মাফাতিহুল জানান নামক দোয়ার সংকলনে বুযুর্গানে দ্বীন এবং আইয়্যামে মুজতাহেদীনের আমলকৃত সাহিত্য গুণসমৃদ্ধ বহু দোয়া সংকলিত আছে যেমন: দোয়া জৌশান কাবির, দোয়া আবু হামজা সুমালি, দোয়া সাহর …ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে চাই আমরা কেউ জানি না, আগামী রমজান মাস ও শব ই কদর পাব কি-না। আমরা জানি না কার জন্য এইবারের রমজান ও শব ই কদর আাখেরি রমজান হয়ে যায়। তাই আসুন এবারের শব ই কদরে বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহপাকের দিদার লাভে সচেষ্ট হই। মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে আমলগুলো করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন