আব্দুল কুদ্দুস, কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি:
কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া বনবিটের আওতাভূক্ত ডলুছড়ায় ‘সামাজিক বনায়ন’ কার্যক্রমে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারী করেছেন বিজ্ঞ আদালত। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিচারাধীন স্বত্ত্ব মোকদ্দমা (নং ৯৭/২০২১) বাদীপক্ষের আনীত নিষেধাজ্ঞা দরখাস্তের শুনানী অনুষ্ঠিত হলে বিজ্ঞ আদালত বিচার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই আদেশ জারী করেন। ১৩ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞ সহকারী জজ আদালত এই আদেশটি জারী করেন।
বেলকুমার (পানাইপুঞ্জি) ১০৫নং দাগে ১৪০ একরসহ অন্যান্য দাগে সহকারী জজ আদালত কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ সম্পর্কিত অবগতিপত্র মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রেরণ করেন বাদীপক্ষের কলবেট পথমি। মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, কুলাউড়ার ইউএনও, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল), সহকারী কমিশনার (ভূমি) কুলাউড়া, থানার ওসি, বনবিভাগের গাজীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা, মুরইছড়া বিট অফিসার ও কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে এর অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি কুলাউড়ার কর্মধার ডলুছড়ায় সামাজিক বনায়নের নামে জুম দখল, পানগাছ কর্তন, খাসিয়া-বাঙ্গালী মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত হওয়ার সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসলে তা নিস্পত্তির লক্ষ্যে দুই পক্ষকে নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশের আয়োজন করেন জেলা প্রশাসন।
জানা যায়, কর্মধার ডলুছড়ায় সামাজিক বনায়নের নামে জুম দখলে খাসিয়া-উপকারভোগির মাঝে সৃষ্ট ঘটনা নিস্পত্তির লক্ষ্যে ৭ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কাঠালতলী বাজারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সেন্টারে সম্প্রীতির সমাবেশে ডলুছড়ার ১০৫ নং দাগের ১৪০ একরের মধ্যে ১০ হেক্টর জায়গায় সামাজিক বনায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাছাড়া খাসিয়া-বাঙ্গালী দুই পক্ষের লোককে সামাজিক বনায়নের উপকারভোগি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে বিট কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন প্রশাসন। ওই সমাবেশে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় প্রশাসন, বনবিভাগ, জনপ্রতিনিধি, উপকারভোগি ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৭ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির প্রথম বৈঠক ১৩ সেপ্টেম্বর সোমবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী।
বৈঠক সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) থেকেই চারা রোপণ কার্যক্রম শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।
ডলুছড়া পুঞ্জির স্থানীয় কয়েকজন খাসিয়া ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে তারা ছোট কালাইগিরির সামাজিক বনায়ন ক্যাম্পে যান। ক্যাম্পে মুরইছড়া বনবিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার, নাইটগার্ড বিল্লাল হোসেন, উপকারভোগি জাহাঙ্গীর আলম, বশির আহমদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারসহ অন্তত ৬০-৭০ জন লোক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খাসিয়াদের মধ্যে কয়েকজন সেখানে উপস্থিত হলে বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার তড়িগড়ি করে বাঙ্গালী শ্রমিকদের নামের তালিকা তৈরীর কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে বাঙ্গালী উপকারভোগির শ্রমিকদেরকে গাছের চারা নিয়ে ডলুছড়া পানজুমের জায়গায় চলে যেতে বলেন এবং দ্রুত চারা রোপণ করার নির্দেশও দেন তিনি। এসময় খাসিয়াদের পক্ষে বোডক গাছের চারা রোপণের জায়গা সরেজমিনে যাওয়ার অনুরোধ করলে বিট কর্মকর্তা অর্জুন সেখানে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে তিনি বোডক খাসিয়ার অনুরোধে তাকে (বোডক খাসিয়া) উপস্থিত শ্রমিকদের দিনের মজুরি দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে সরেজমিন চারা রোপণ করার জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এবং বোডক খাসিয়াকে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে নিশ্চিত করান। পরে ডলুছড়ার পানজুমের জায়গায় উপস্থিত হয়ে যেখানে পানজুম ও গাছ-গাছালি রয়েছে সেখানে বাঙ্গালী উপকারভোগি নয় বরং খাসিয়া উপকারভোগিরা ইচ্ছে করলে গাছের চারা রোপণ করতে পারবেন বলে উপস্থিত সকলকে জানান দেন তিনি। পাশাপাশি ডলুছড়ার ওই পানজুম এলাকাটি ১৪০ একর জায়গার অর্ন্তভূক্ত এবং সেটি সামাজিক বনায়নের আওতায় আছে বলেও দাবী করেন অর্জুন কান্তি দস্তিদার।
বিট কর্মকর্তা প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেন- ডলুছড়া পানজুমের সাথে সম্পৃক্ত রেখেই তারা (বাঙ্গালী উপকারভোগি) গাছের চারা রোপণ করবে। এখানে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
এই সময় বিট কর্মকর্তার দেখিয়ে দেওয়া জায়গাটি ১৪৬ একরের অর্ন্তভূক্ত এবং জায়গাটি নিয়ে স্বত্ত্ব মামলা বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে দাবী করেন বোডক খাসিয়া। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলার অনুরোধ করেন বোডক খাসিয়া। কিন্তু বিট কর্মকর্তা প্রথমে তাতে অনীহা প্রকাশ করেন। খাসিয়ারা জানান- ১৪৬ একর জায়গা নিয়ে বিজ্ঞ আদালতে স্বত্ত্ব মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর এই ১৪৬ একর জায়গাকে ১৪০ একর দেখিয়ে প্রশাসনকে ভুল তথ্য দিচ্ছেন বিট কর্মকর্তা। খাসিয়ারা আরো জানান, প্রশাসনের লোকজন সরেজমিন গহীন এলাকায় না যাওয়াতে তিনি (অর্জুন কান্তি দস্তিদার) ভুল তথ্য দিয়ে প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।
ডলুছড়া পুঞ্জির হেডম্যান লবিং সুমের জানান, আমরা সামাজিক বনায়নের বিপক্ষে নয়। তবে যে জায়গা নিয়ে (১০৫ দাগের ১৪৬ একর) বিজ্ঞ আদালতে স্বত্ত্ব মামলা বিচারাধীন রয়েছে সেখানে সামাজিক বনায়নে গাছের চারা রোপণ করা যাবে না, যেমনটি প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারাও বলেছেন। কিন্তু বিট কর্মকর্তা জোরপূর্বক ওই জায়গায় গাছের চারা লাগাতে চান। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিন্তু তিনি মামলা দিয়ে দেখে নিবেন বলে আমাদেরকে শাষাচ্ছেন।
মুরইছড়া বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার জানান, ইউএনও কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার চারা রোপণের কথা ছিল। আমরা ৬০-৭০ জন শ্রমিক নিয়ে সেখানে যাই। এসময় খাসিয়ারা চারা রোপণে বাধা দেয়। বিষয়টি ইউএনও এবং ওসিসহ বনবিভাগের কর্মকর্তাদের জানিয়ে শ্রমিক নিয়ে ফিরে এসেছি।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী জানান, বিষয়টি তিনি জেনেছেন। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) কমিটির সদস্যদের নিয়ে সরেজমিন যাবেন।
মন্তব্য করুন