নুরুজ্জামান ফারুকী হবিগঞ্জ থেকে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় কুশিয়ারা নদীর তীর প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মান কাজ নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। এই মেগা প্রকল্পের ৫৭৩ কোটি টাকার কাজ নিয়ে ভানুমতির খেলা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের নীরবতার জন্য দ্বায়সারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর এই মেগা প্রকল্পের দূর্নীতির তদন্ত দাবি করেছেন। এই প্রকল্প থেকে অনেক নেতাই কমিশন গ্রহনের অভিযোগ রয়েছে। বিশাল প্রকল্পের হরিলুট নিয়ে সর্বত্র হইছই হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তের দাবি তুলেছেন সচেতন মহল। কুশিয়ারা প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বাঁধটি নড়বর অবস্থায় আছে। বাঁধের নি¤œমানের কাজ হওয়ার জন্য বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। বর্তমানে চরম আতংকে আছেন হবিগঞ্জ জেলার ভাটি অঞ্চলের মানুষ। বিশাল প্রকল্পে ৫৭৩ কোটি টাকা গেল কোথায় এই প্রশ্ন সবার মাঝে। তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে সচেতন মহলে। বর্তমান সরকারের কাছে এই বিশাল প্রকল্পের দূর্নীতি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারের ফলে কাজ শেষ হওয়ার প‚র্বেই ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীণ নদীর তীর প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বেশকিছু স্থান দেবে ফাটল দেখা দিয়েছে এই বিষয়টি গত বছরে “তীর রক্ষার প্রকল্প রক্ষা করবে কে” শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় সরজমিন রিপোর্ট প্রকাশ হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যোগসাজসেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ তীরবর্তী মানুষের। প্রভাবশালী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মামলার ভয়ে অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলেননি তখন এলাকাবাসী। জানা যায়- হবিগঞ্জের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ “কুশিয়ারা ডাইক” প্রতি বছর বর্ষায় ভেঙে নবীগঞ্জ, সিলেটের ওসমানী নগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামসহ ভাটি ও হওরা লের বাড়িঘর ও কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে যায় পানির নীচে। নদীর উভয় তীরের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী ছিল বর্তমান প্রযুক্তিতে নতুন ভাবে কুশিয়ারা উভয়পাশে বাঁধ নির্মাণের জন্য।
প্রতি বছরে এমন বিধ্বংসী ভাঙন রোধে ও অকাল বন্যা থেকে রক্ষা পেতে জাতীয় সংসদে কুশিয়ারা উভয় তীর রক্ষায় জিও ব্যাগ ও বøক দিয়ে প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে কুশিয়ারা ডাইক রক্ষার জন্য এই বিশাল টাকার প্রকল্প গ্রহন করা হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীর রক্ষায় প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার এলাকায়জুড়ে প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মানে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকের সভায় অনুমোদন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দরপত্র আহবানের কাজ পায় ৫টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, সে গুলো হলো, গোলাম রব্বানী কন্টাকশন, এএইচ ট্রেডিং কোং, আরএফএল, নেশন ট্রেক কমিশন ও আবুল কালাম কোং। তারা ১১টি প্যাকেজে কাজ শুরু করেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রেসম‚হের সম্মুখে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরের প্রতিরক্ষা প্রকল্পের কাজ।
এর মধ্যে এ এই্চ ট্রেডিং কোং, আরএফএল ও নেশন ট্রেক কমিশনের কাজে ফাটল দেখা দিয়েছে। আরএফএল এ পরিচালক রাসেল আহমদ জানান, তাদের কাজের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়নি সবার কাজেই ফাটল দেখা দিয়ে নীচে দিয়ে দেবে গেছে। তারা আগামী শুস্ক মওসুমে সবাই কাজের সংশোধন করার জন্য চেষ্টা করবেন। অন্যান্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরেননি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ শুরুর পর থেকে কুশিয়ারা নদীর তীর প্রতিরক্ষায় বøক নির্মাণে মাটি যুক্ত বালু, নুরি পাথর, ছোট পাথরের জায়গায় বড় পাথর, গোটা পাথর, মরা পাথর ও পাথরের সাথে ধুলোবালিযুক্ত অবস্থায় ঢালাই, ইটের খোয়া মিশ্রন, অধিকাংস্থানে সিমেন্টের তুলনায় অতিরিক্ত বালি ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে বøক নির্মাণ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের যোগসাজসেই আওয়ামীলীগের নেতাদের কমিশন দিয়ে এমন অনিয়ম হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নবীগঞ্জের পাহাড়পুর অংশে সেখানে গুণগত মানের সিমেন্ট ব্যবহার করা হলেও সিমেন্টের তুলনায় মরা পাথর, অতিরিক্ত বালি ব্যবহার করতে দেখা যায়। বন্যার পানি আসার সাথেই কুশিয়ারা ডাইক এসব বøক গুলো কোথায়ও ভেঙ্গে গেছে আবার কোথায় নীচে দিয়ে দেবে গেছে। এ বিষয়ে আব্দুল জব্বার নামে একজন বলেন, সরকারী দলের নেতাদের জন্য কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। তাই এক বছরের মাথায় সব টাকা জলে ভেসে গেছে এই বিষয়ে দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ তদন্ত করে থলের বিড়াল বাহির করা প্রয়োজন। এছাড়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশন টেক ট্রেডিং, আরএফএল ট্রেডিং করপোরেশন নিম্নমানের মালামাল দিয়ে বøক নির্মানের ফলে লামা তাজপুর এলাকার খোয়াজ উল্লাহ, জিলু মিয়া ও বাছিত মিয়ার বাড়ির সামনেসহ বেশ কিছু স্থানে কুশিয়ারা প্রতিরক্ষা প্রকল্পের ভাঙ্গন দেখা গেছে।
শেরপুর এলাকার জুয়েল আহমদ বলেন- বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মাণ ছিল সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ কিন্তু নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করার ফলে প্রতিরক্ষা প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে কুশিয়ারা ডাইকটি নড়বরে হয়েগেছে। এসব অনিয়মের তদন্ত করে পিছনের রাগব বোয়ালদের বাহির করা প্রয়োজন।তাজপুর এলাকার তাজুল ইসলাম জানান- নিম্নমানের বালি ও মরা পাথর দিয়ে শুরু থেকেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো ডাইকে নির্মাণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আসেন সবকিছুই দেখেন কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও অফিসাররা মিলেমিশেই দুর্নীতি করেছে। তখন এলাকার মানুষ মামলার ভয়ে প্রতিবাদ করে নাই।
লামা তাজপুরের খোয়াজ উল্লাহ ডাইক নির্মাণে অনিয়মের কথা জানিয়ে তিনি বলেন- প্রতিবাদ কে করবে, কোথায় করবে কেনই বা করবে, ৫শ-৬শ কোটি টাকার প্রকল্প আমরা প্রতিবাদ করলে অল্পকিছু টাকা খরচ করলেই আমাদের মামলা দিয়ে হয়রানী করতো তখনকার সময়ে আওয়ামীলীগের পাতি নেতারা। এছাড়া অফিসাররা সবকিছু জানেন কিন্তু চুপ হয়ে ছিলেন, এখন এসব তদন্ত করে সব কয়টির বিরুদ্ধে মামলা করা প্রয়োজন। ওই এলাকার জিলু মিয়া বলেন- নিম্নমানের পাথর বøক তৈরি করা হয়। কাজে বালু-পাথর ও সিমেন্ট মিশ্রণের সঠিক অনুপাত মানা হয়নি। দায়সারা ভাবে কাজ করে সব টাকা ভাগ বন্টন করে খেয়েছেন আওয়ামীলীগের নেতারা আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠন। আওয়ামীলীগের সব নেতাই তখন ঠিকাদার হয়ে গেছিলেন।
নবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী সেফু বলেন- কুশিয়ারা ডাইক নির্মাণে অনিয়ম র্দুর্নীতির বিষয়ে তড়িৎগতি কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানিয়ে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের ৫৭৩ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয়েছে এটা বাহির হওয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন- কুশিয়ারা নদীর উভয় তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ কয়েকটি প্যাকেজের মাধ্যমে কাজ চলমান রয়েছে। এ কাজগুলো ম‚লত নদী ভাঙনরোধে করা হচ্ছে এটা ভালো অবস্থায় আছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেবে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন আমাদের কাজে কোন অনিয়ম হয়নি। দুই বছর ধরে সাংবাদিকরা শুধূ অনিয়ম হয়েছে বলে আসছে” আমরা কোন অনিয়ম পাইনি”। চলমান কাজে আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। অনিয়ম হলে আপনারা তদন্ত করেন।
মন্তব্য করুন