কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।মাহবুবুল আলম
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতিকে কেন্দ্র করে একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী ক্যাম্পাসকে আবারও উত্তপ্ত করতে চাইছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নামে ধর্মান্ধ মৌলবাদী ইসলামী ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ হিযবুত তাহেরী বুয়েটকেঅশান্ত করার নীল নকশা করছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত ও সরকার বিরোধীরা একটি ইস্যু সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের নোংরা খেলায় মেতে ওঠার পায়তারা করছে বলেওঅনেকেই মনে করছে।
গত কয়েক বছর ধরে বুয়েট বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠীরনিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ এবং সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেই। এই চিহ্নিত গোষ্ঠীটি বুয়েটে ছাত্রলীগেরজনীতি ঠেকানোর কাজ করে যাচ্ছে। বুয়েটে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পেছনে রয়েছে পরিকল্পিত মৌলবাদী চক্রান্ত।
তারা আবরার ঘটনাটাকে ছাত্রলীগের ঘাড়ে চাপিয়ে ছাত্রলীগ বিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তৈরি করেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র শিবির এবং হিজবুত তাহেরীরা তাদের কর্মকান্ড চালাচ্ছে অন্য কেউ চালাতে পারছে না। বাস্তবতা হলো যে, বুয়েটে প্রগতীশীল রাজনীতিকে বন্ধ করে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের রাজনীতি চালু করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বুয়েট ছিল মুক্ত চিন্তা, প্রগতীশীল চিন্তা-চেতনার অগ্রসর একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে এখানে ছাত্র ইউনিয়নের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এখানে হিজবুত তাহেরী এবং ছাত্র শিবিরের আধিপত্য বাড়তে থাকে। এখনতো এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে হিজবুত তাহেরী এবং ছাত্রশিবির।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এর জেরে ওই বছরের ১১ অক্টোবর বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আবরার ফাহাদের হত্যাকান্ডের পর থেকে বুয়েটে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছাত্রলীগ বিরোধী এবং ছাত্র রাজনীতি বিরোধী একটি আবেগ তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, এই পরিস্থিতিটি তৈরি হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। আবরার ফাহাদের ঘটনাটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং পুরো বিষয়টিকে রং মাখিয়ে রাজনীতিকরণ করা হয়, যাতে এখানে ছাত্রলীগের রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যায়।
আবরার ফাহাদের ঘটনার পর এটিকে একটি বড় ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে এটিকে পরিকল্পিত ছাত্রলীগ বিরোধী একটি ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন তারা ঐ ঘটনার পর থেকে বুয়েটের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। এর পর থেকে বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় বুয়েটে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড না থাকলেও সেখানে হিজবুত তাহেরী এবং শিবির প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে আর এদের ছায়াসঙ্গী হয়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ছাত্রদল। বুয়েটের বিভিন্ন ছাত্রাবাসগুলোতে এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে হিজবুত তাহেরীর তৎপরতা চালাচ্ছে। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিয়ে হিজবুত তাহেরী ও ইসলামি ছাত্রশিবির বুয়েটে একচ্ছত্র রাজত্ব চালাচ্ছে।
বুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠনগুলো কমিটি গঠনের পাশাপাশি রাজনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ জুলাই বুয়েটে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধেও।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বীর হলের সিট পুনর্বহালে বুয়েট প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। রোববার (৩১ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে এ আলটিমেটাম দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “সুনামগঞ্জের স্থানীয় জামায়াতের আমির ও ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই ৩৪ জন শিবির ক্যাডারের মুক্তির দাবি করেছিল। এসব শিবিরের ক্যাডার জামিনে বের হয়ে এসে আবার বুয়েটকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে।
তিনি বলেন, বুয়েট প্রশাসন দাবি না মানলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মরা বুয়েটে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কমিটি দিয়ে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে বুয়েট প্রশাসনকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে।”
এব্যাপারে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ করেন, “ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার নামে বুয়েটে নিষিদ্ধ ছাত্ররাজনীতির চর্চা শুরু হয়েছে। হিজবুত তাহরির, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন উগ্র ও মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন এখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং তাদের রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ অনুভূতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটির মাধ্যমে যে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে আমরা সেটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই।”
পরিশেষে এই বলেই শেষ করবো যে, বুয়েট হলো দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি অবাধ হলেও একমাত্র বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত ভাবনার বিচরণ ক্ষেত্র। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যায়গুলোর বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আজকে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক নেতারা দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বে ছিলেন। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ছাত্ররাজনীতি বহাল আছে সেখানে কেবলমাত্র বুয়েটে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিত্ব মুক্ত করার ঘোষণা দিতে পারে না। আর তা করলে এটা হবে বিশ্ববিদ্যালয় চেতনার পরিপন্থি। বুয়েটে যারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পায়তারা করছে এর পেছনে একটি সুগভীর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে আজ উচ্চাদালতের এক ঐতিহাসিক রায়ে আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের এই অপচেষ্টা নস্যাৎ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া জরুরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বৈধতা নিয়ে আজ হাইকোর্টে একটি রিট হয়। রিটটি করেন একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন। তিনি বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। এই রিটের শুনানি শেষে আদালত বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আদেশ স্থগিত করেন।
মন্তব্য করুন