স্টাফ রিপোর্ট :
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (ইউএনডব্লিউটিও) ঘোষিত বিশ্ব পর্যটন দিবস। ১৯৮০ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট’ বা ‘পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ’। উন্নত, অনুন্নত, পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক সব রাষ্ট্র নির্বিশেষে পর্যটন হলো অর্থনীতির অন্যতম খাত। বছরে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতিতে যোগ হয় পর্যটন খাত হতে। এ মুহূর্তে পর্যটন হলো বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। ২০২০-২১ সালে কোভিড পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে পর্যটন। এ খাতটি অর্থনীতির অন্যান্য খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যোগাযোগ ও যাতায়াত, আবাসন, কর্মসংস্থান, স্থানীয় কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ, আইনশৃঙ্খলাÑ সবকিছু পর্যটনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তাই পর্যটন খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া মানে অন্যান্য খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। অন্যদিকে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি এলেই মানুষের মধ্যে দেশ-বিদেশের সৌন্দর্য ঘুরে দেখার সাধ জাগে। তাই দেখা যাচ্ছে পর্যটন যেমন অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও পর্যটনকে সমৃদ্ধ করে।
যাহোক, কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে দ্রুত ঘুরেও দাঁড়িয়েছে পর্যটন খাত। ডব্লিউটিওর তথ্য মতে, ২০২১ সালে সারাবিশ্বে এক বিলিয়নেরও বেশি আন্তর্জাতিক পর্যটক কমেছে। এতে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় কমেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর। ২০২২ সাল থেকে পর্যটন খাত আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা ১০২ শতাংশ বেড়েছে। যদিও তা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম, তবুও ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে পর্যটকের সংখ্যা ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ডব্লিউটিওর সেক্রেটারি জেনারেল জুরাব পোলোলিকাশভিলিও আশা প্রকাশ করেছেন, এ বছরের শেষ দিকে বিশ্ব পর্যটন খাত কোভিড-পূর্ব যুগের অবস্থায় ফিরে যাবে। পরে এই খাতে জড়িত মানবসম্পদ এবং বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে সবার জন্য প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি বাড়বে। পর্যটনে প্রবৃদ্ধি বাড়ায় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, নাকি অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ায় পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটছেÑ সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে এবং তা হচ্ছে। তবে এটি ঠিক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণের সময় পর্যটন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিশ্বকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) সফলতার পর এখন সব রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে। ওই এসডিজেতে বিশেষ অবস্থান পর্যটন খাতের। আবার এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিবেশ এবং জলবায়ু সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এসডিজি গ্রহণ করাই হয়েছে বিশ্বকে আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য রেখে উন্নয়ননীতি ও পরিকল্পনা যাতে গ্রহণ করা হয়, এদিকটির ওপর বিশেষ গুরুতে দিয়ে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পর্যটন খাতে পরিবেশগত দিক বিবেচনার বিষয়টি উঠে এসেছে অনেক আগে থেকে। ইকো-ট্যুরিজম ধারণা অনেক পুরনো।
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে সমাপ্ত বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির ফোরাম জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো (এসডিজি) অর্জনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে পর্যটনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের ৮০ শতাংশ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক এই ফোরামের জরিপ থেকে বের হয়ে এসেছে এসডিজির ১৭টি স্বতন্ত্র। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জনে পর্যটনের খাতের ভূমিকা কতটুকু। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে এসডিজি বিশ্বের সব রাষ্ট্রের জন্য অনুসরণীয়। যে কোনো অর্থনৈতিক প্রকল্প, উন্নয়ন পরিকল্পনা তথা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হিসেবে এসডিজি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। আর ওই এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্যে রয়েছে পর্যটন খাতের উল্লেখযোগ্য অংশীদার। তবে রাষ্ট্রভেদে এই অংশীদারের মাত্রা ভিন্ন। জি-২০ সম্মেলনে ২০ সদস্য রাষ্ট্র ও আমন্ত্রিত ৬ রাষ্ট্রসহ ২৬টি দেশের সরকারপ্রধান পর্যটন খাতে বিনিয়োগের জন্য ৫টি অগ্রাধিকার খাতের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছান। এর মধ্যে পরিবেশবান্ধব পর্যটন খাত ছিল সর্বাগ্রে। পরবর্তী ৪টি খাত হলো পর্যটনে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, পর্যটন স্পট ব্যবস্থাপনা, দক্ষতা এবং পর্যটন খাতে মধ্যম ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা। ব্রিকস সম্মেলনেও পর্যটন খাত বিশেষ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল।
বিশ্বের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগামীতে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একেক দশকে একেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় লড়েছে। যেমনÑ দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার রোধ, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য, গণতন্ত্রায়ণ। এসব চ্যালেঞ্জ একেক রাষ্ট্রের সামনে একেকভাবে এসেছে। যেমনÑ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ঔপনিবেশ-উত্তর তথা ষাটের দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য যখন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টারত, তখন উন্নত দেশগুলো সারাবিশ্বে গণতন্ত্রের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বেড়ায়। শিল্পোন্নত দেশগুলো মুক্তবাজার অর্থনীতি হয়ে বিশ্বায়নের মাধ্যমে সারাবিশ্বের বাজারে নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু বর্তমানে সবার সামনে একটিই চ্যালেঞ্জ। সেটি হলো আগামীর বিশ্বকে টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে বাঁচার চ্যালেঞ্জ। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহার এবং বায়ুমণ্ডলে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিগর্মন; সেহেতু বিশ্বের, বিশেষত উন্নত দেশগুলো যাতে শূন্য কার্বন নিগর্মনে কাজ করেÑ এ জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরাম থেকে চাপ আসছে। তবে সফলতা অনেক দূর। যেহেতু পর্যটন খাতের আবাসন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিনোদনকেন্দ্রে বিপুল পরিমাণ ব্যবহৃত বিদ্যুৎ আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে; পর্যটক পরিবহনে বিমান থেকে শুরু করে স্থানীয় যাতায়াতের শক্তির মূল উৎস খনিজ তেলÑ সেহেতু ধরে নেওয়া যায় পর্যটন খাতও বায়ুমণ্ডলে কার্বন জোগানের জন্য দায়ী। তাই দেখা যাচ্ছে, পর্যটন খাতের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির শক্ত সংশ্লেষ বা যোগসূত্র রয়েছে। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে টেকসহ পর্যটনব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
বৈশ্বিক পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে উপকূল, সৈকত ও সমুদ্র পর্যটন। আবার জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে হুমকিতে রয়েছে উপকূল এলাকা। বিশ্বের প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষের বাস উপকূলীয় এলাকায় তথা সমুদ্র থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। পর্যটকদেরও ভ্রমণের শীর্ষ গন্তব্য হচ্ছে উপকূল, সৈকত ও সমুদ্র এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যদি উপকূলীয় ও সৈকত এলাকা সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যায় বা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যায়, তা হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম উৎস পর্যটন খাতের কী হবে? আর এসব এলাকায় বসবাসকারী বিশ্বের মোট জনগণের ৪৪ শতাংশের জীবন-জীবিকা তো দূরে থাক, তারা বেঁচে থাকবে কিনাÑ এ প্রশ্ন সামনে এসেছে।
বিশ্বের পর্যটনকেন্দ্রগুলো মূলত গড়ে উঠেছে পাহাড়, পর্বত, অরণ্য, বন, জলাভূমি, উপকূল, নদ-নদী ও সমুদ্র কেন্দ্র করে। আবার পরিবেশ ও জবায়ুর হটস্পটও এসব এলাকা। এদিক থেকেও পর্যটনের সঙ্গে জলবায়ু ও পরিবেশের একটি যোগসূত্র রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে যদি এসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে সেটি হবে পর্যটনের। আবার অনিয়ন্ত্রিত ও অটেকসই পর্যটনে যদি এসব এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা হলে হুমকিতে পড়বে পুরো এলাকার জীববৈচিত্র্যসহ মানুষ ও প্রাণীকুল। পর্যটনের স্বার্থেই জলবায়ু পরিবেশকে নির্মল রাখা ও সংরক্ষণ প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে বিশ্বের অস্তিত্ব যখন মহাসংকটে, তখন বিনিয়োগটি যেন পরিবেশবান্ধব হয়Ñ এ ব্যাপারে পর্যটন খাত সংশ্লিষ্ট সবার পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে সচেতন করার লক্ষ্যে পালিত হচ্ছে দিবসটি। তবে অর্থনীতি ও উন্নয়নের সব খাতেই পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ প্রয়োজন। যেহেতু জলবায়ু ও পরিবেশের সঙ্গে পর্যটনের বিশেষ সংশ্লেষ রয়েছে, সেহেতু জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক ফোরামগুলো চাচ্ছে পর্যটন খাতের অস্তিত্বের স্বার্থেই পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের দিকে এখনই গমন প্রয়োজন।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক : ভাইস চ্যান্সেলর, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট ও আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে দৈনিক আমাদের সময় এর উপ-সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত
মন্তব্য করুন