মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী: “রাজনীতি বিলিয়ে দেওয়ার জন্য বিলিওনিয়ার হওয়ার জন্য নয়।”- প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। “যেদিন রাজনীতি থেকে টাকা উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে, সে সময় ৯০% নেতা রাজনীতি ছেড়ে কাজে মন দেবে।”-প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫% একটিভ রাজনীতি করেন-তাঁদের মধ্য থেকে ৮% সৎ, বাকী ৭% অসৎ, সৎ রাজনীতিবিদরা সংখ্যায় মাত্র ১% বেশী হলেও অসৎদের ইউনিটি ও অপকৌশল এর কারণে তাঁরা অসহায় – তাঁরা তাঁদের সততা জাহির করতে পারেন না। তবে সৎ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা দৃশ্যমান ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ করা গেলে তখন অসৎ রাজনীতিবিদরা অপকৌশলে ক্ষান্ত দিতে বাধ্য হতেন। একটিভ সৎ রাজনীতিবিদদের সাথে দেশের রাজনীতি বিমুখ ৮৫% জনগণের মধ্য থেকে ১০% কিংবা ১৫% যদি রাজনীতিতে একটিভ হয়ে যেতেন-তাহলে অসৎ রাজনীতিবিদরা ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার ফলে অনৈতিকতার চর্চা অবশ্যই থামিয়ে দিবেন। অনৈতিকতার চর্চা তখন আর সম্ভব হতো না।
গত আগস্ট মাসে Tweet বার্তায় প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ৯০% রাজনীতিবিদকে প্রকারান্তরে অসৎ কিংবা অবৈধভাবে টাকা উপার্জনের জন্য রাজনীতি করে থাকেন বলে মন্তব্য করলেও আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তা কিন্তু ৭%। মূল্যায়ন ম্যান টু ম্যান ভ্যারি হতে পারে।
রাজনীতি-রাজার নীতি, রাজকীয় নীতি, সমৃদ্ধির নীতি, সুখের নীতি, সেবা ও ত্যাগের নীতি। পৃথিবীর দেশে দেশে চলমান রাজনীতি খেয়াল করলে দেখা যায় সমৃদ্ধ ও সুখী দেশগুলো রাজনীতি দিয়েই নিজেদের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছেন অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রাজনীতি না বুঝার কারণে চরমভাবে পিছিয়ে আছে। রাজনীতির কারণেই বাঁচা কিংবা মরা! আসলেই পুরো পৃথিবীই রাজনীতিময় পৃথিবী!
বায়ুমন্ডলের রাজ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে অনবরত অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থেকে অক্সিজেনকে অপছন্দ করা যেমন তেমনি রাজনীতির পরিমন্ডলে থেকে রাজনীতিকে অপছন্দ করাও তেমন। অতএব রাজনীতিকে অপছন্দ করে সরাসরি রাজনীতি করা থেকে বিরত থাকা কারো উচিত নয়।
“রাজনীতি বিলিয়ে দেওয়ার জন্য বিলিওনিয়ার হওয়ার জন্য নয়।” আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর এই কথার সাথে আমি কিছুটা দ্বিমত পোষণ করছি।
বিলিয়ে দিতে দিতে, বিলিয়ে দেওয়া রাজনীতিবিদদের অস্তিত্বও একসময় থাকবে না। তাছাড়া প্রায় ৫০ বছর রাজনীতি করে বৈধভাবে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করতঃ প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জো বাইডেন কথাটি বলেছেন-পূর্বে এ রকম মন্তব্য শোনা যায়নি।
মাকড়সার মতো নির্মমভাবে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় নিজের দেহকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিলিয়ে দিয়ে/ধ্বংস করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু করা – তা নিজের উপর জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে রাজনীতিতে এরকম কেউ করেন না-তবে বক্তব্যে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য বেশিরভাগ নেতা নিজেদেরকে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলে থাকেন-যা ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে অবচেতনভাবে ঘটনাচক্রে অনেক কিছু হয়ে যায়। আর সেসবকে পুজি করে কপট রাজনীতিবিদরা নেতৃত্ব দেওয়াটা কেবলমাত্র নিজেরই অধিকার মনে করে বসে এবং জনগণের কাছে রাজনীতিতে তার ব্যাপক ত্যাগ রয়েছে বলে প্রচার করতে থাকে। আসলে ত্যাগটি ঘটনাচক্রে ত্যাগ। কিন্তু সহজ সরল জনগণ তা যথাযথ যাচাই না করে সেসব নেতাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
ধরুন! ঘটনাচক্রে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জনগণের সহানুভূতি ও জনগণের মাঝে পরিচিতি পাওয়া নেতাদের ৫০% সততা রয়েছে অন্যদিকে জনগণের মাঝে পরিচিতি নাই -এ রকম নেতাদের কিন্তু ৯০% সততা রয়েছে। ঘটনাচক্রের সম্মুখীন না হওয়ার দরুন পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা না পাওয়ার কারণে ৯০% সৎ লোকগুলো নির্বাচনে জনগণের সমর্থন পেলো না অন্যদিকে ঘটনাচক্রে পরিচিতি পাওয়া ৫০% সৎ লোকগুলো পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার কারণে জনগণের সমর্থন পেয়ে এমপি হয়ে গেলো কিংবা সরকার গঠন করে ফেললো কিন্তু আমার কথা হলো ৯০% সৎ লোকগুলো যারা পরিচিতি কিংবা সহানুভূতি পাওয়ার মতো কোন ঘটনার সম্মুখীন না হওয়ার কারণে জনগণের সহানুভূতি নামক অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। এখন প্রশ্ন হলো ক্ষমতা গেলে পরে ৫০% সততা লালনকারী ব্যক্তিদের বাকী ৫০% অসততার টানে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী নাকি ৯০% সৎ ব্যক্তিদের মাত্র ১০% অসততার টানে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী?
সহানুভূতি পাওয়া নেতারা সহানুভূতিকে পুঁজি করে এবং জনগণের একটা অংশকে পক্ষে আনার জন্য চাতুরীপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে, জনগণের সমর্থন নিয়ে যাতে জনগণকে ধোঁকা দিতে না পারে-তারজন্য দেশের সহজ-সরল জনগণকে খেয়াল রাখতে হবে নচেৎ জনগণের সমর্থন নিয়ে তাঁরা নিজেদেরই আখের গোছাতে থাকবে। পূর্বের অসৎ রাজনীতিবিদদের অনুকরণ করে রাজনীতি করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন অব্যাহত রাখবে।
রাজনীতিতে যারা ফুল টাইম নিজেদেরকে শামিল করেছেন-তাঁদেরতো থাকা-খাওয়া লাগবেই। আর এই থাকা-খাওয়ার জন্য বৈধভাবে যেসব ফ্যাসিলিটিস রয়েছে – তা-ই যথেষ্ট। সেসব ভোগ করা দোষের নয় কিন্তু বৈধ সেসবের পাশাপাশি যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন – তাঁরা অবশ্যই দোষ করছেন – আর তাঁরাই দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে রাজনীতি সম্পর্কে বিরুপ ধারণা দিয়ে চলেছেন। আর তাই দেশের সিংহভাগ মানুষ খারাপ রাজনীতিবিদদের কারণে রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখে থাকেন। কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কলুষিত রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার জন্য এগিয়ে এসে, প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনীতির মাঠে মেজরিটি অসৎ ৯০% রাজনীতিবিদদের সাথে, আর আমার মতে, প্রবলভাবে একতাবদ্ধ ও কৌশলী অসৎ (দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে রাজনীতিতে একটিভ ১৫% এর মধ্যে ৭% অসৎ) ৭% রাজনীতিবিদ এর সাথে পেরে উঠতে না পেরে ক্ষান্ত হয়ে যান। কিন্তু দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫% -যারা রাজনীতিবিমুখ-তাঁদের মধ্যে থেকে ব্যাপক মানুষ রাজনীতিতে একটিভ হলে – এবং তা পূর্ব থেকে রাজনীতিতে একটিভ থাকা অসৎদের সংখ্যাকে ব্যাপকভাবে ছাড়িয়ে গেলে- সৎ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী হয়ে যাবে আর এতে করে রাজনীতিকে যারা একমাত্র টাকা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেন – তাঁরা আর টাকা ইনকাম করতে পারবেন না- প্রেসিডেন্ট এর মন্তব্য অনুসারে টাকা উপার্জনকারী ৯০% রাজনীতিবিদ রাজনীতি ছেড়ে তাঁদের স্ব স্ব কাজে মন দিতো। অসৎ রাজনীতিবিদরা অসততা ত্যাগ করে যাতে ভালোতে পরিণত হতে পারেন-তারজন্য সৎ মানুষদের ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে শামিল হওয়া উচিত।
সৎ দাবীদার যারা-তাঁরা অসৎদের চেয়ে বেশী সংখ্যায় সংগঠিত হয়ে রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান সৃষ্টি করা, বর্তমান দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই জরুরি। একটিভ রাজনীতি থেকে বিরত থেকে অসৎদের কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর অবারিত সুযোগ আলাতুন দেওয়ার জন্য সৎ ও রাজনীতিবিমুখরাও কি দায়ী নন?
অযোগ্য ও অসৎদেরকে রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দিয়ে কিংবা তাঁদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসার সুযোগ করে দিয়ে-তাঁদের অযোগ্যতা কিংবা অসততার কারণে তাঁরা দূর্নীতি করে থাকলে – তাঁদেরকে এককভাবে দোষারোপ করা তাঁদের উপর অবিচার নয় কি? আমি কিংবা আপনি রাজনীতিতে সরব কিংবা একটিভ না হয়ে তাঁদের উপর রাজনীতির যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দেওয়ার কারণে-তাঁদের অসততার দায়ভার আমি কিংবা -আপনার উপর একটুও কি বর্তাবে না? আসলে দেশের প্রতি আমি-আপনি -আমরা তথা পুরো দেশবাসী দায়বদ্ধ। আমরা দায় এড়িয়ে চলার কারণেই এতো সমস্যা।
রাজনীতি আমার অপছন্দ, রাজনীতিকে আমি ঘৃণা করি-বর্তমান দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব বলে রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই।
বায়ু মন্ডলের রাজ্যে নিজেকে সার্বক্ষণিক ডুবিয়ে রেখে অনবরত অক্সিজেন গ্রহণ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে অক্সিজেনকে অপছন্দ করা যেমন প্রতিনিয়ত ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় রাজনীতির আবর্তে আবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিকে অপছন্দ করাও তেমন। রাজনীতির সুফল যেমন আমরা ভোগ করছি – তেমনি কুফলও ভোগ করছি। প্রতিনিয়ত অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকলেও আমরা অক্সিজেনকে অনেকেই তেমন গুরুত্ব মনে করি না-গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে না করা-সে সব ব্যক্তিরা নিজেদের জন্য কিংবা তাঁদের মুমূর্ষু আত্মীয়দের জন্য যখন হাসপাতালে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, অক্সিজেন সংকট থাকলে তখন হাড়ে হাড়ে টের পায়-অক্সিজেন কী জিনিস। তদ্রূপ আমি – আপনি তথা আমরা মানুষরা রাজনৈতিক জীব (man is political being) হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতি থেকে বিমুখ থেকে নিজেদের চেয়ে কম যোগ্য কিংবা অসৎদের হাতে রাজনীতির যাবতীয় ভার তুলে দিলে-তাঁরা অনিয়ম করে থাকলে-তারজন্য আমি-আপনি কিংবা আমরাও কি দায়ী হবো না? অক্সিজেন এর গুরুত্বকে অবহেলাকারী হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটে পড়ে অক্সিজেন এর গুরুত্ব যেভাবে হাড়ে হাড়ে টের পায় – তদ্রূপ রাজনীতিতে আমার-আপনার অসম্পৃক্ততার দরুন খারাপ রাজনীতিবিদদের খারাবির আছড়- আমাদের উপর আপতিত হলে কিংবা দুষ্ট রাজনীতির ঘেরাকলে পড়ে যখন আপনি কিংবা আমি নিষ্পেষিত হতে থাকবো-তখন রাজনীতির গুরুত্ব হারে হারে টের পাবো। কিন্তু তখন ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকা ছাড়া উদ্ধার এর কোন পথ থাকবে না। সে অবস্থা হবার পূর্বে রাজনীতিতে একটিভ হওয়া কি আমাদের উচিত নয়?
রাজনীতির অনিবার্য কুফল আমার-আপনার উপর আপতিত হবার পূর্বে এবং সময় থাকতে দেশের ৮৫% জনগণের রাজনীতিতে একটিভ হওয়া খুবই জরুরি।
সময় থাকতে যদি আমরা একটিভ না হই-তবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ সময় শেষ হওয়ার দরুন আপসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
লেখক
সহ-সভাপতি
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
চট্টগ্রাম মহানগর শাখা
মন্তব্য করুন