অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুরঃ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ আগামীকাল মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুরে আসছেন। এদিন তিনি লক্ষ্মীপুরে নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ২ হাজার পরিবারের জন্য নির্মিত গণকবর ও মসজিদের নামফলক উন্মোচন করবেন। লক্ষ্মীপুরে এটি তার প্রথম সফর।
লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ এর লক্ষ্মীপুরে আগমনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পুলিশ মহাপরিদর্শক মঙ্গলবার সকালে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম চরমনসা গ্রামে নির্মাণ করা কবরস্থান ও মসজিদটির নামফলক উন্মোচন করবেন। এরপর লক্ষ্মীপুর পুলিশ লাইন্সে জেলা পুলিশের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করবেন তিনি।
অনুষ্ঠানে পুলিশের সদর দপ্তর এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
জানা যায়, মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে গত দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি উপজেলার প্রায় অর্ধেক তলিয়ে গেছে। নদীতে ভিটে-মাটি হারানো অন্তত দুই হাজার পরিবার এখন রামগতি-লক্ষ্মীপুর সড়কের ওপর বসবাস করছেন।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ থেকে কমলগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত আট কিলোমিটার এলাকায় সড়কের দুপাশে কোনোমতে অস্থায়ী ঘর তুলে তারা বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন।
সড়কের পাশে ঘর তুলে বসবাস করতে পারলেও তাদের অন্যান্য মৌলিক চাাহিদা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। এতে পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলেই বিপাকে পড়তে হয় তাদের। নিজস্ব কোনো জায়গা ও কবরস্থান না থাকায় বাধ্য হয়েই যেখানে-সেখানে করতে হয় মরদেহ দাফন। এছাড়া মসজিদ না থাকায় অনেক দূরে গিয়ে অথবা ঘরে আদায় করতে হতো নামাজ।
নদী ভাঙা মানুষে কথা চিন্তা করে পুলিশের আইজিপির উদ্যোগে জেলা পুলিশ এসব সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য গণকবর ও মসজিদ নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ২ হাজার পরিবার পুলিশের পক্ষ থেকে অকল্পনীয় উপহারটি পাওয়ায় কপালে চিন্তার ভাঁজ আর থাকছে না তাদের। এতে পুলিশের প্রশংসা করছেন স্থানীয় সর্বস্তরের লোকজন।
স্থানীয়রা জানান, স্বজন হারানোর বেদনার চেয়েও তাদের কাছে বেশি চিন্তার বিষয় কবরের জায়গা না থাকা। মৃত্যুর পর অনেক সময় মরদেহ নিয়ে কয়েক ঘন্টা বসে থাকতে হয়। কোথায়, কার জমিতে মরদেহ দাফন করা যাবে, তা নিয়ে সবসময় কাজ করে অস্থিরতা। কারো মৃত্যু হলে শুরু হয় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি। এছাড়া নিজেদের কবরস্থানে অন্যের কবর দিতেও অনীহা জানান অনেকে। এতে করে নদী ভাঙা মানুষ গুলোর শেষ যাত্রা হয় বিড়ম্বনার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের আইজিপির উদ্যোগে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের আবদুর কুদ্দুসের কাছ থেকে পশ্চিম চরমনসা গ্রামে সাড়ে ২৯ শতাংশ জমি খরিদ করেন। গত বছরের ১ ডিসেম্বর জমিটি রেজিস্ট্রি করা হয়। এরপর থেকে পুরো জমিতে সীমানা প্রাচীর তুলে কবরস্থান ও মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। সেখানে গভীর নলকূপ, মরদেহ ধোয়ার ঘর ও শৌচাগার রয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে গণকবরে যাওয়ার জন্য রাস্তাও সংস্কার করা হয়েছে।
সড়কের দুপাশে বসবাস করা আইয়ুব আলী, লোকমান হোসেন, ইমন ব্যাপারী, ও দুলাল মিয়া বলেন, আমাদের সকলের বাড়ি রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় ছিল। মেঘনার ভাঙনে তা নদীতে চলে গেছে। আমাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে দাফনের জন্য মরদেহ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। কারণ আমাদের দাফন করার জায়গা নেই। এখানে বসবাস করা প্রত্যেক মানুষের প্রায় একই গল্প। আগে স্থানীয়রা বাধা না দিলেও কয়েক বছর ধরে জমির দাম বাড়ার কারণে কেউ কবরের জন্য এক ইঞ্চি জমি দিতে রাজি হয় না।
ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল হাসান রনি বলেন, সড়কের দুপাশে বসবাসকারীরা নদী ভাঙনের শিকার। তারা সবাই এখন সহায়-সম্বলহীন। কোনোমতে অস্থায়ীভাবে তারা বসবাস করে জীবনযাপন করে আসছে। অসহায় এসব মানুষের জন্য আধুনিক কবরস্থান ও মসজিদ তৈরী করে পুলিশের আইজিপি আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাদের কাছে।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর পুলিশ সুপার ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, মৃতদের কবর দেওয়া নিয়ে নদীভাঙা মানুষের দুশ্চিন্তার বিষয়টি নজরে পড়ায় বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী জমি কেনাসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে সেখানে কবরস্থান, মসজিদ, মরদেহ ধোয়ার ঘর ও শৌচাগার নির্মাণ এবং গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে মঙ্গলবার সকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ এটির নামফলক উন্মোচন করবেন।
মন্তব্য করুন