মাহবুবুল আলম।।
গত দেড় বছর ধরে করোনার সর্বগ্রাসী থাবায় এমনিতেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়েছে। চাকুরি হারিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে অনেকের আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এই সময়ের ক্ষয়-ক্ষতির ট্রমা এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেনি বেশিরভাগ মানুষ। এমতাবস্থায় লাগামহীনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। তাই সর্বত্রই সরকারের সমোলোচনা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে।
কালোবাজারী, মুনাফাখোর, মজুতদারের কারণে খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। তাই অধিকাংশ নিত্যপণ্যের মূল্যই এখন নিম্ন-আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য ক্রমেই বাড়ছে। দেশে এক শ্রণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গোপনে গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য এসব ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে। কিন্তু সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়। শুল্ক বৃদ্ধির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সরকার কঠোর নজরদারি ও তদারকির মাধ্যমে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে ভেঙে দিয়ে পণ্যের অবৈধ মজুদ ও কৃত্রিম সংকট বন্ধ করার মাধ্যমে এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। কিন্তু অনেক সময়ই প্রভাবশালী অসাধু ব্যবসায়ীগণ পার পেয়ে যায় ফলে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য কমে না।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম; আলু, পেঁয়াজ, আদা, মুরগির দামও বাড়তি। সরু চালের পর এবার মোটা ও মাঝারি মানের চাল ইরিস্বর্ণা, পাইজাম ও লতার দামও বাড়তি। রাজধানীর খুচরা বাজারে মোটা ও মাঝারি মানের চালের দাম এক সপ্তাহের মধ্যেই দুইবার বাড়েছে। শুধু চালের দামই নয়, গত এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের মধ্যে রয়েছে আলু, পেঁয়াজ, আদা ও ব্রয়লার মুরগিও। এছাড়া গত প্রায় দুই মাস ধরেই ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির। টিসিবির হিসেবে গত এক বছরে মোটা চালের দাম ৪১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, সরু চালের দাম ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ ও মাঝারিমানের চালের দাম ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে দফায় দফায় চালের দাম।
সম্প্রতি দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ এ প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে যা নিন্মরুপ : “রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮০ টাকা কেজি। যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৫-৫০ টাকা। আর ৪০-৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আমদানি করা পেঁয়াজ গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকা। দেশি আদা বিক্রি হয়েছে ১৮০-২০০ টাকা কেজি, আর বিদেশি ১০০-১৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যা এক মাস আগেও ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা। এছাড়া আমদানি করা রসুন বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা কেজি, আর দেশি রসুন কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা। সয়াবিল তেল (বোতল) লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫৫ টাকা। দেশি মসুর ডাল কেজি বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি। যা এক মাস আগেও ছিল ১৪০-১৫০ টাকা লিটার। এক মাস আগেও ৪০-৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ময়দা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৬-৫০ টাকা কেজি। ব্রয়লার মুরগি কেজি প্রতি বিক্রি হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকা। যা একমাস আগেও বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা কেজি। ডিম ডজনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকা। চিনির দাম নতুন করে না বাড়লেও ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। তবে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যে বাজারে পণ্যর দাম একটু কম রয়েছে।
সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। এ কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। চালের পাশাপাশি চাল, তেল ডাল, আটা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বাজারে ক্রমাগত বেড়েই চলছে তেল ও চিনির দাম। বিশ্ববাজারের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে দর সমন্বয় করতে গিয়ে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে দাবি করছেন ওইসব পণ্যের মিল মালিকরা। কিন্তু দরের কারণে এখন তাদের সবার ‘পোয়াবারো’। অন্যদিকে প্রতি কেজি চিনি ৮৫ টাকা আর তেল প্রতি লিটার ১৫৩ টাকা, এতে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
একশ্রেণীর অতি মুনাফালোভী, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সীমিত আয়ের লোক এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র লোকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের মূল্য ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
ব্যবসায়ী বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আটকে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। সরকারকে এ অসাধু ও অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজারে মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, অনিয়ম প্রমাণিত হলে বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।
সরকার ইতোমধ্যে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এতে কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যদি নাগালের মধ্যে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হ্রাস পাবে।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক
মন্তব্য করুন