মাহবুবুল আলম
পবিত্র রমজান মাস প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মহিমান্বিত মাসে মুসলমানরা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহপাকের দিদার লাভের জন্য এবাদত করে। আল্লাহ চান মানুষ যেন তাঁর ইবাদত করে, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে। সমাজের অন্ধকার ও সকল পাপ-পঙ্কিলতা থেকে দূরে থেকে ইবাদত ও মানব কল্যাণে নিজকে নিয়োজিত রাখে। রমজান মাস মানুষকে ত্যাগ, সততা, সংযম, উদারতা, পূন্যবান হবার অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দেয়। জীবন ও আখিরাতের সুখ সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহ মুসলিমদের জন্য অনেক সুযোগ দিয়ে রেখেছেন। তার মধ্যে রমজান মাস অন্যতম।
নামাজের পরই সার্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত রমজান মাসের রোজা রাখা। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষ পুণ্যলাভের পাশাপাশি আত্মিক বা আধ্যাত্মিক এবং স্বাস্থ্যগত বিবিধ উপকারিতা লাভ করে। রোজায় যেমন অসৎ কাজ পরিহার করে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা যায় তেমনি খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রিত হয়ে স্বাস্থ্যেরও উপকার হয়। এই পবিত্র মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারাবছরের পাপ ও আত্মশুদ্ধির জন্য মহান আল্লাহর কাছে মাগফেরত কামনা।
ইসলামের বিধান মোতাবেক গীবত হারাম ও কবিরা গুনাহ। যারা অন্যের আগে বা পিছে তাদের দোষ ত্রুটি বলে বেড়ায় তাদের জন্য ইসলামে ধবংসের দুঃসংবাদ রয়েছে। “পবিত্র কোরআনে সূরা আল-হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, আর তোমরা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না।” এই আয়াতের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাবারেক ওয়াতালা গীবত বা পরনিন্দা কতটা পছন্দ করেন না।
রোজা রাখা অবস্থায় গীবত করলে রোজা ভাঙে না সত্য কিন্তু তাতে রোজার সংযম, সওয়াব ও গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। গীবত কবিরা গোনাহ। শুধু রোজা নয় রোজা ছাড়াও অন্যান্য সময়ে এটি খুবই নিকৃষ্টতম কাজ ও অভ্যাস। রমজান মাস হলো পবিত্র মাস। তাই এ-পবিত্র রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। এর বাইরেও হিংসা বিদ্বেষ নয় রোজাদারদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহানুভূতি থাকা দরকার।
একই কথা প্রযোজ্য পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা, বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতার বিষয়ে। ইসলামেরদৃষ্টিতে খুবই নিন্দনীয়। এত সামাজে সমাজে,গোত্রে গোত্রে শান্তিশৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়।তাই এসমস্ত আচরণ বর্জন প্রত্যেকেরই কর্তব্য। কারও দোষ বা কুৎসা রটানো, গীবত করা হল পরচর্চা ও পরনিন্দা। এসব কাজ সমাজের কাছে যেমন নিন্দনীয় তা কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতেও অত্যন্ত পাপের কাজ।
পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ভাষায়, মানুষের মধ্যে ‘তাকওয়া’র গুণ সৃষ্টির লক্ষ্যে রোজা পালনকে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘তাকওয়া’র অর্থ হলো- আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের অনুভূতি। আল্লাহতায়ালার পূর্ণ বিশ্বাস এবং তাঁর অসীম ক্ষমা অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগ্রত করা। তাছাড়াও রাগ-ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস লালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তাঁর প্রতি ভয়ের ও মান্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা ও ভয়ের এ মিলিত মানসিক অবস্থার নামই হলো- ‘তাকওয়া। ’তাই পবিত্র রমজান মাসে সংযম ও মনুষ্যত্ব চর্চার অবারিত সুযোগ অনেক বেশি।
রমজান মাস ত্যাগের মাস, ভোগের নয়। রমজান মাস দান-খয়রাতের মাধ্যমে আখিরাত অর্জনের মাস, অধিক মুনাফার মাধ্যমে দুনিয়ায় অর্জনের মাস নয়। যদি কোনো ব্যক্তি বৈধ পন্থায় হালালভাবে ব্যবসা করেন, তবে আল্লাহ তাতেই বরকত দেবেন। অন্যায়ভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দ্বীনদার পরহেজগার রোজাদারদের কষ্ট দিলে, ওই অর্থ ও সম্পদ তাঁর ইহকাল ও পরকালে কোনোই উপকারে আসবে না।
রমজান মাসের বিশেষ আমল হলো নিজেকে সকল প্রকার কু রিপু থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আল্লাহর দেখিয়ে দেয়া বিধানমতে সংযত জীবনযাপন করা। নিজের চোখ, জিহ্বা, কান, মুখ, কামনা সবকিছু সংযত করে রেখে রোজা পালন করতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা শুধু না খেয়ে নয়, বরং অন্যান্য সৎ গুণাবলীর চর্চা করা করা রমজানের মহাত্ব্য। রাসুল (সঃ) বলেছেন ,” সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে যে ব্যাক্তি রোজা রাখবে তার সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে”(বুখারী ও মুসলিম)।
পবিত্র রমজান মাসে খাওয়া দাওয়ায়ও সংযমী হতে হবে ইফতারের সময় হলে খেজুর খেয়ে পানি পান করাই যথেষ্ট। এতে শরীরে আসবে তাৎক্ষণিক প্রাণশক্তি। চিনির শরবতেরও প্রয়োজন হবে না। এতে ফ্যাটসহ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। পেঁয়াজু, চপ, বেগুনি, পাকোড়ার মতো ভাজাপোড়া না খাওয়াই ভালো, কারণ এতে হজমের অসুবিধা, বুক জ্বালাপোড়া ও এসিডিটির সমস্যা হতে পারে। পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, মোগলাই, হালিম, চাইনিজ খাবার, গরু ও খাসির গোশত ইত্যাদি এ মাসে যত কম খাওয়া যায় তত ভালো। কিন্তু আমরা দেখছি রমজান মাসে মানুষ এসব খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তা না করে মাগরিবের নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয়াটাই উত্তম। এতে একদিকে যেমন সাশ্রয় হবে অন্যদিকে দেহ অতিরিক্ত খাবারের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বেঁচে যাবে।
সাহরিতেও খাদ্যাভ্যাস সঠিক হওয়া আবশ্যক। প্রোটিন পানির তৃষ্ণা বাড়ায়। সাহরিতে তাই মাছ-মাংস বর্জন করাই স্বাস্থ্যসম্মত। খিচুড়ি, ডিম, ডালেও যেহেতু প্রোটিন আছে তাই এগুলোও না খাওয়া ভালো। অল্প পরিমাণ ভাত-সবজি বা কলা-খেজুর বা দই-চিড়া খেলে সারা দিন শরীর খুব ঝরঝরে থাকবে। তবে একেবারে কিছুই না খাওয়া, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে সাহরি বর্জন ঠিক নয়।
রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘তোমরা রোজা রাখো যেন সুস্থ থাকতে পারো।‘ অনেকের ধারণা রোজা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। অথচ সম্প্রতি গবেষণাগুলো উঠে আসছে রোজা রাখার শারীরিক উপকারিতা নিয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য।চিকিৎসা বিজ্ঞানে এজন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি। রোজা বা উপবাসে সাময়িক খাদ্য বন্ধের ফলে দেহকোষের অভ্যন্তরে সৃষ্ট টক্সিন ধ্বংস করে দেয় যার নাম অটোফেজি।
রোজা রাখলেও রমজান মানে যে সংযম, তা মানছে না কেউ। রোজা মানে শুধু দিনভর উপোস নয়; রোজার মর্মার্থ, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে। কম খেতে হবে। ভোগবিলাস ত্যাগ করতে হবে। লোভ-লিপ্সা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে হবে। করতে হবে দান ও ক্ষমা। কিন্তু এদেশে পবিত্র রমজান যেন হাজির হয় একটু ভিন্ন রূপে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আতঙ্ক নিয়ে। রমজান আসলেই যেন এদেশের বাজারে আগুন লাগে। অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে যায় সাধারণ মানুষ। তারা রোজার এক মাসেই সারাবছরের লাভ করে ফেলতে চায়; ইসলামের দৃষ্টিতে এটা যে কত বড় গর্হিত কাজ তা কোরআন হাদিসে বর্ণিত আছে। তবু তা জেনে শুনেই অসাধুু ব্যবসায়িরা রোজার মাসে আতর সুরমা লাগিয়ে টুপি পরে ইসলামী লেবাস লাগিয়ে পাক্কা মুসল্লী সেজে মানুষ ঠকানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।
মহান আল্লাহপাক এসব গোমরাহি থেকে রক্ষা করে আমাদের রোজাকে কবুল করে দুনিয়া ও আখিরাতে অশেষ সওয়াব দান করুন। আমিন!
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন