মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী
মানুষ জন্মগতভাবে স্বার্থপর, লোভী ও অহংকারী। তবে স্থান কাল পাত্র ভেদে উপরোক্ত স্বভাবের ব্যক্তিকে (সন্তান, পিতা-মাতার সাথে কিংবা সম্পর্কের কারণে ঘনিষ্ঠ হওয়া ব্যক্তিদের সাথে কিংবা বয়স বাড়া, বার্ধক্য, অসুস্থতা কিংবা স্থান পরিবর্তনে) সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রেও দেখা যায়। অর্থ্যাৎ স্থান কাল কিংবা পাত্রভেদে স্বার্থপরতা, লোভ ও অহংকার এর ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়-ব্যাপকভাবে সেসব উঠানামা করে। ৯৮% ব্যক্তি পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে নিজ থেকে সেসব ত্যাগ করতে পারেন তবে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যা সংখ্যায় ২% এর বেশী হবে না-তারা কোন অবস্থাতেই সেসব খারাপ স্বভাব এর নিম্নমুখী তারতম্য ঘটানোর চিন্তাও নিজ থেকে মাথায় আনেন না। তারা থাকেন অনড়-সুযোগ বুঝে তা আরো বাড়িয়ে চলে। সেসব খারাপ স্বভাব এর মোহে তারা এতই আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে, হিতাহিত জ্ঞানও তাদের অনেকটা বিলোপ হয়ে যায়। সেসব কারণে সহায়-সম্পত্তিসহ জানও অদূর কিংবা দূর ভবিষ্যতে হারাতে হবে-সেটা বুঝেও অহংকার ও লোভের মোহে আচ্ছন্নতার কারণে তারা নিজ থেকে সংশোধন হন না। উক্ত ২% এর সাথে খুবই সম্পর্কিত অন্য ৫%-৭% যারা, তারা বুঝালে অবশ্যই তারা সংশোধন হবে-কিন্তু তারাও নিজেদের স্বার্থের কারণে উক্ত ২% কে সংশোধনের জন্য পরামর্শ দেন না। আবার ৫%-৭% এর সাথে সম্পর্কিত ১০%-১৫% যারা তারা ৫% -৭%কে নিজেদের স্বার্থের কারণে সৎ পরামর্শ দেন না। এভাবে নিচের দিকে যতো যাবো-আমরা মানুষদের মধ্যে বেশ আর কম স্বার্থপরতা দেখতে পাবো। পরম্পরায় স্বার্থের লিংক দেখতে পাবো। আমি কিংবা আপনিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। নিচের দিকের দূর্নীতি কিংবা স্বার্থপরতা বড় বড় দূর্নীতিবাজদের তুলনায়-যতোই কম কিংবা তুচ্ছ মনে হোক না কেন-স্বার্থপরতা কিংবা দূর্নীতি দূর্নীতিই। তাছাড়া অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে। আর তাই আমার বক্তব্য হলো অনিয়ম ও দূর্নীতির জন্য দেশের সব মানুষ (আমি কিংবা আপনি) বেশ আর কম দায়ী।
মাঝে মাঝে কিংবা কালে ভদ্রে দূর্নীতিবাজ আর আলাতুন দূর্নীতিবাজ এর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। কালেভদ্রে দূর্নীতিবাজ যারা-তারা দূর্নীতি করার পর অনুশোচনা করেন। ভালো হওয়ার মন মানসিকতা পোষণ করে থাকেন।
অন্যদিকে আলাতুন দূর্নীতিবাজরা দূর্নীতি করতে করতে এতই অভ্যস্ত হয়ে যান যে, তারা দূর্নীতিতে মজা পান, দূর্নীতিকে অধিকার মনে করে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প- পাহাড়ী ও দূর্গম এলাকার এক গৃহস্থ তার পালিত একটি গরু বহুদূরের গরুর হাটে বিক্রি করতে নিলেন। তা জানতে পেরে একদল ডাকাত লোকটি থেকে বিক্রিলব্ধ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তার ফেরার সময়ে পথে অপেক্ষা করতে লাগলো। এদিকে লোকটি প্রত্যাশিত দর কেউ দিতে রাজী না হওয়ায় গরুটি সেই হাটে বিক্রি না করে পরবর্তী দিন পাশ্ববর্তী অন্যহাটে বিক্রির জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে দূরের পথ বাড়িতে না এনে হাটের পাশের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গরুটি রেখে আসেন। ফেরার পথে ডাকাত দল লোকটিকে ধরে গরু বিক্রির টাকা তাদেরকে দিয়ে দিতে বললো। লোকটি গরু বিক্রি করে নাই -বললেও লোকটির সাথে গরুটি না দেখে ডাকাত দল বিশ্বাস করছিলো না। তার সমস্ত শরীর চেক করার পর টাকা না পেয়ে ইচ্ছেমতো মারা শুরু করলো। টাকার হদিস না পেয়ে পরে এক পর্যায়ে ডাকাতরা গরু কেন বিক্রি করে নাই -তা জানতে চাইলে লোকটি বলে-দাম কম এবং লস হবে -তাই বিক্রি করে নাই-তা শুনে ডাকাতদল ক্ষেপে আরো বেশি মারতে মারতে বলতে থাকে যে, “লস হলে আমাদের (ডাকাতদের) হতো! তুই কেন বিক্রি করিসনি।” তদ্রূপ দূর্নীতিবাজরা অন্যের সম্পত্তিকে নিজের মনে করে থাকে। দূর্নীতি চলমান রাখতে না পারলে-তারা অস্থির ও বেপরোয়া হয়ে যান।
দূর্নীতির অনুকূল পরিবেশ এর কারণেই মূলত দূর্নীতিবাজদের মন মানসিকতা এরকম হয়েছে কিংবা হচ্ছে। দূর্নীতির পরিবেশ নির্মূল না করে দূর্নীতিবাজদের যতোই হিতোপদেশ দেওয়া হোক না কেন-দূর্নীতি বন্ধ হবে না। সেলুকাস ব্যাপার হচ্ছে -যারা ব্যাপক দূর্নীতি করে তারাও বলে দূর্নীতি নির্মূল করতে হবে। তাদের উক্ত কথা অসার ও ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজেদেরকে সৎ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য মূলত তারা এভাবে বলে থাকেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের সেসব কথা বিশ্বাস করে বারবার প্রতারিত হলেও আবারো বিশ্বাস করে।
এই আমরা যারা বারবার তাদের উপর আস্থা রেখে ম্যান্ডেড দিয়ে দূর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছি -তারজন্য তাদের পাশাপাশি আমরা তথা দেশের সব জনগণও দায়ী।
এই আমরা যারা বারবার তাদের উপর আস্থা রেখে ম্যান্ডেড দিয়ে দূর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছি -তারজন্য তাদের পাশাপাশি আমরা তথা দেশের সব জনগণও দায়ী।
আমাদের বুঝার দরকার রাজনীতি ও দূর্নীতি করতে করতে রাজনীতি ও দূর্নীতিকে যারা নিজেদের কেবলমাত্র, একমাত্র, শুধুমাত্র অধিকার হিসেবে মনেপ্রাণে গেঁথে নিয়েছে-তাদেরকে পূনরায় ম্যান্ডেড দিলে কোনদিন দেশ থেকে দূর্নীতির পরিবেশ নির্মূল হবে না। দূর্নীতি যাদের কাছে নীতিতে পরিণত তারা ব্যতীত মোটামুটি ভালোদের মধ্য থেকে একটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি হলে তাদের প্রভাবে ক্রমান্বয়ে ২% আলাতুন দূর্নীতিবাজরাও ভালো হয়ে যাবেন। শতভাগ সততায় ফিরে না আসা পর্যন্ত আপাতত প্রতিষ্ঠিত দূর্নীতিবাজদের বাদ দিয়ে বাকীদের মাধ্যমে দূর্নীতির পরিবেশ নির্মূলে চেষ্টা চালালেই কেবল দেশকে দূর্নীতি মুক্ত করা যাবে। কিন্তু মোটামুটি সৎ লোকগুলো তাদের চলমান সুখ-শান্তি ও স্বার্থ যাতে ব্যাহত না হয় (ভয়ে) তারজন্য তেমন এগিয়ে আসেন না। এটাও এক ধরনের স্বার্থপরতা। পরিবার-সংসার, নিজস্ব ব্যবসা এসব নিয়ে এরকম স্বার্থপরতা সবারই থাকা দোষের নয় বরং প্রশংসনীয়। দেশের স্বার্থে তা দরকার-কারণ ব্যক্তি সমৃদ্ধ হওয়া মানে প্রকারান্তরে দেশ সমৃদ্ধ হওয়া। প্রথমে ব্যক্তি সমৃদ্ধ, পরে পরিবার, পরে সমাজ ও দেশ এভাবে দেশের কল্যাণ নিহিত হয়ে থাকে। এই অর্থে ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রীকতা প্রত্যেকের জন্য সবচেয়ে বড় স্বার্থ বলা যায় এবং তা অবশ্যই বড় স্বার্থ। সেই স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা আমাদের প্রত্যেকেরই করা উচিত। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে সেটাই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত।
কিন্তু বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে -সে অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করা না গেলে ব্যক্তি, পরিবার ও সম্পত্তি সবই খোয়া যাবে। বিগত ৫০ বছর ধরে দেশে বিরাজিত সব দলের অনেক লোকসহ দেশের রাজনীতিবিমুখ লাখো লাখো লোক যে তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন-সেসব একটু চিন্তা করুন। সর্বস্ব খোয়ানো যে কত কষ্টের! কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ঘোষণা করছে যে, ভবিষ্যতে দেশে এমন অবস্থা সৃষ্টি হবে-অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দেশ আফগানিস্তান, সোমালিয়া, ইরাক কিংবা লিবিয়ায় পরিণত হয়ে যাবে তখন আপনার -আমার সহায়-সম্পত্তি কোন কিছু কি ঠিক থাকবে? জান নিয়ে টানা টানি হবে। নিজের বৃহত্তর স্বার্থও দেশের বৃহত্তর স্বার্থের সাথে একাকার হয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। এরকম যাতে না হয় তারজন্য সময় ও সুযোগ থাকতে দেশের রাজনীতি বিমুখ মানুষদেরকে নিজেদের ব্যক্তিগত বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে বর্তমান ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগপূর্বক দূর্নীতির পরিবেশ নির্মূলে দল মত ধর্ম নির্বিশেষে কার্যকর একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে এগিয়ে আসা খুবই জরুরি।
লেখক
সদস্য, কেন্দ্রীয় ফোরাম
বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি।
মন্তব্য করুন