এমনিতেই দীর্ঘ ছয় মাস ধরে গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্য উত্তাল। ৭ অক্টোবর ২০২৪ হামাসের হামলা থেকে যার সূত্রপাত। সেই দিন হামাস ইজরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ। স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিতে বরাবর হামাসকে সমর্থন করলেও ৭ অক্টোবরের হামলার পিছনে তাদের হাত নেই বলে দাবি করেছিল ইরান। কিন্তু, ইজরায়েল বরাবরই হামাসের বন্ধুরাষ্ট্র ইরানকে শত্রুদেশ হিসেবেই গন্য করে আসছে।
দীর্ঘদিন থেকেই ইরান-ইসরায়েল একে অপরের প্রতি চরম বৈরীভাবাপন্ন দুইটি দেশ। সম্প্রতি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান-ইসরায়েল বৈরিতা নতুন করে শুরু হয়েছে। কারণ, হামাসের প্রধান সহায়তাকারী হচ্ছে ইরান। কিন্তু ইসরায়েল যখন হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে, তখন অনেকের মধ্যেই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, এই যুদ্ধ হয়তো শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সাল থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে, যে আগুন নেভার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না।
আমরা যতটুকু জানি, ইরান হামাস যোদ্ধাদের শুধু সমর্থন নয় অস্ত্র সহায়তা দিয়েও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে ইরানকে একহাত নিতে ১ এপ্রিল ২০২৪ ইসরায়েল ইরানি কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে সেখানে ১৩ জনকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের ৭ জন সদস্য ছিলেন। এই ৭ জনের মধ্যে আইআরজিসির বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ইউনিট কুদস ফোর্সের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল রেজা জাহেদিও আছেন। সেসময়ই ইরানের শীর্ষ নেতা আলী খোমেনি বলেছিলেন, ‘জায়নবাদী ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়া হবে।’
খোমেনির এ হুমকীর ১৩ দিনের মাথায় ইরান ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এদিন ইরান ৩০০-র বেশি মিসাইল এবং ২০০ ড্রোন নিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালায়। যদিও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবি করেন, আমেরিকার সাহায্যে সমস্ত ড্রোন ভূপাতিত করেছে তারা।
১৩ এপ্রিল ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর থেকেই ওই অঞ্চলে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এনিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকের আশঙ্কা ইরান ইসরায়েল সংঘাত শেষ পর্যন্ত না আবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে মোর নেয়। সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েল যে উস্কানিমূলক হামলা চালায় এর প্রতিশোধ হিসেবে মাধ্যপ্রাচ্যের পরমাণু শক্তিধর দেশ ইরান ড্রোন ও মিসায়েল হামলা চালিয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। একই সাথে এই পরিস্থিতিকে একটি আঞ্চলিক সংঘাতের হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েল-ইরান দুই দেশের তিক্ত সম্পর্ক ক্রমেই বড় সামরিক সংঘাতের দিকে এগুচ্ছে। পাশাপাশি অনেকটা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্ররা। ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার সম্ভাব্য পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের চার মার্কিন মিত্র সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও কুয়েত। দেশগুলো জানিয়েছে, তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইরানের ওপর কোনো প্রকার হামলা চালাতে দেওয়া হবে না।
ইরানের হামলা মোকাবিলায় এরইমধ্যে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পাশাপাশি ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি ও মধ্যপ্রাশ্চ্যের মুসলিম প্রধান দেশ জর্ডান। জর্ডান ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে মাঠে নেমেছে।
ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর সৌদি আরব সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অঞ্চলে ‘সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ‘যুদ্ধের বিপদ’ এড়াতে সব পক্ষকে সংযমের এই আহ্বান জানায়।
তেহরানের এমন হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরমাণু পরাশক্তি চীন। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান, চীন চলমান উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বৃহৎ আকারে সংঘাত প্রতিরোধ করতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে শান্ত ও সংযমী আচরণ করার আহ্বান জানায়।
ইরান ও ইসরায়েলের চরম উত্তেজনার মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিলেও ইরানে পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের সঙ্গে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে পেন্টাগন। এমনকি ইসরায়েলি হামলায় তারা সমর্থন পর্যন্ত দেবেন না। রোববার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে মার্কিন নিউজ ওয়েবসাইট অ্যাক্সিওস।
এ বিষয়ে বিশ্বর বিভিন্ন সমরবিদ ও বিশ্লেষকরা ইসরায়েল-ইরান সংঘাত পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনারের বলেন, “ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের পরিণতি কী হতে পারে তা এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ইসরায়েল ঠিক কীভাবে শনিবার রাতে চালানো হামলার জবাব দেয়, তার ওপর। তিনি আরও বলেন,, “মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশ্বের অন্যত্রও বহু দেশই কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছে। এর মধ্যে এমন অনেক দেশও আছে, যারা ইরানের সরকারকে ঘোরতর অপছন্দ করে।
কিন্তু এখন তারাও চাইছে ইসরায়েল যেন নতুন করে এই হামলার জবাব দিতে না যায়। অন্য দিকে ইরানের মনোভাব অনেকটা এই ধরনের : ‘অ্যাকাউন্ট সেটলড – মানে শোধবোধ হয়ে গেছে। ব্যাস, বিষয়টার এখানেই ইতি টানলেই ভাল।” ( বিবিসি বাংলা )
আল–জাজিরার কূটনীতিক সম্পাদক জেমস বেইস মনে করেন, দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলার পর এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তাতে একটি চক্র পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ হামলা হয়েছে, পাল্টা হামলা হয়েছে। তাঁর মতে, এখন এ চক্র শেষ হওয়ার পরে নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটলে অর্থাৎ ইসরায়েল যদি আবারও হামলা চালায় তাতে বিপদ নেমে আসবে।
তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) স্কুল অব ল-এর আইন ও বৈশ্বিক অধ্যয়নবিষয়ক প্রভাষক বেঞ্জামিন রাড মনে করেন, হামলায় হতাহতের সংখ্যা যেন কম হয় তা মাথায় রেখে হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছে ইরান। দ্য স্ট্রেট টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বেসামরিক লোকসমাগমের কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্যবস্তু না করে সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করার মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত মিলেছে যে ইরান চায় না উত্তেজনা আর বাড়ুক। তারা কেবল দামেস্কে তাদের দূতাবাস প্রাঙ্গণে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দেশের ভেতরে যে চাপের মধ্যে ছিল, তা থামাতে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমেরিকা ও এর পশ্চিমা মিত্রদের আশঙ্কা ছিল এই ভেবে যে, সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলের ওই হামলার প্রত্যুত্তর না দিয়ে বসে তেহরান। ইরানের যেকোনো ধরনের প্রত্যুত্তর গোটা অঞ্চলকে শুধু নয়, গোটা বিশ্বকেই বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইরান মিসাইল এবং ড্রোনের সম্মিলিত হামলায় ইজরায়েলকে ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করেছে। সীমান্ত থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের টার্গেটে আঘাত করতে সক্ষম ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ় মিসাইলও রয়েছে তাদের ভাঁড়ারে। তৈরি ইজরায়েলও। ইউএসের সাহায্য ছাড়াও নিজেদের বাহিনী তৈরি রেখেছে তারা। বাতিল করা হয়েছে কমব্যাট ফোর্সের সকলের ছুটি। আনা হয়েছে রিজার্ভ ফোর্সও। জিপিএস-নেভিগেটেড ড্রোন বা মিসাইলকে ধ্বংস করার প্রযুক্তিও তৈরি রেখেছে ইজরায়েল।
তাছাড়া, এ অভিযানের মাধ্যমে ইরান সবাইকে এটা দেখাতে চেয়েছে যে, কৌশলগত সামরিক সফলতা অর্জনের সক্ষমতা ইরানের হাতে রয়েছে। আর এই সফলতার একটি হচ্ছে, ইরান বহু বছর ধরে বলে আসছিল তারা একই সাথে পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে সক্ষম।
এবারই প্রথম বারের মতো নিজের ভূমি থেকে ইরান সরাসরি ইসরাইলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের’ সূচনা করেছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষাবাহিনীর (আইডিএফের) একজন সাবেক মুখপাত্র জানিয়েছেন: ‘আমি ইরানের কাছ থেকে ইরানের মাটি থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ আশা করিনি। এটি এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশকে টেনে আনবে।’
সকলেরই জানা ইরানের নেতারা ইহুদি রাষ্ট্রটির ঘোরতর বিরোধী এবং তারা ‘ইসরাইলকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার’ কথা বলেছেন। ইসরাইল বিরোধী অনেক উগ্র গোষ্ঠীকে সমর্থনও দিচ্ছেন। তাদের পরমাণু কর্মসূচিই যে শুধু ইসরাইলের মাথাব্যথার কারণ তা নয় – ইরানের হাতে আছে দীর্ঘপাল্লার এবং জাহাজ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্রের মতো উন্নত অস্ত্রও। এসব অস্ত্র লেবাননের হেজবোল্লাহকে দিয়েছে ইরান।
তবে সংঘাত এড়াতে ব্যাপক কূটনীতিক তৎপরতা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন বৃহত্তর সঙ্কট এড়াতে আপাতত উত্তেজনা প্রশমন করতে চায়৷ এজন্য ইসরায়েলকে পাল্টা হামলা না চালানোর আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে স্পষ্টভাবে বাইডেন জানিয়ে দিয়েছেন, তেল আবিব কোনো হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে না।
তবে পরিশেষ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে মহারণ লেগে যাক আশা করে না। এমনিতেই করোনা অতিমারির ধকল সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছে তার ওপর ইরায়েল-ইরান সংঘাত যদি মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও আরও অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে তা হবে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র’ সামিল যা গোটা বিশ্বকে মহাদুর্ভিক্ষর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, আল জাজিরা, ভয়েস অব আমেরিকা, সমকাল, ইউটিউব, বাংলা ট্রিবিউনসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
১৭ এপ্রিল ২০২৪
ডেট্রয়েট, মিশিগান, ইউ.এস.এ
মন্তব্য করুন