করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়া শুরু করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে এই কর্মসূচিতে আপাতত রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের। জান্তা-নিয়োগকৃত স্থানীয় এক প্রশাসক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা জানিয়েছেন।
কিয়াউ লুইন নামে ওই কর্মকর্তা সিটওয়ে এলাকা থেকে জানান, ১০ হাজার মানুষকে টিকাদানের লক্ষ্য নিয়ে তাদের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এতে প্রবীণ, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
তবে ঘনবসতিপূর্ণ সিটওয়ে শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের করোনারোধী টিকার দেয়ার কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই বলে জানান এ কর্মকর্তা। এতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে কি-না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা শুধু আদেশ পালন করছি।
কিয়াউ বলেন, এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে আমরা কত টিকা এবং কী ধরনের নির্দেশনা পাব তার ওপর। এখন পর্যন্ত আমরা ওই বিষয়ে (রোহিঙ্গাদের টিকাদান) কোনো নির্দেশনা পাইনি।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য মিয়ানমার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ফোন করেছিল রয়টার্স। তবে তাদের কেউই কল রিসিভ করেনি।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর বহু স্বাস্থ্যকর্মী আন্দোলনের সমর্থনে কর্মবিরতিতে যাওয়ায় মিয়ানমারের করোনা মোকাবিলা কর্মসূচি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে। সম্প্রতি রেকর্ড সংক্রমণের পর অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে জান্তা সরকার। গত কয়েকদিনে দেশটিতে দৈনিক তিনশ’র বেশি মানুষ করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন, যদিও এর প্রকৃত সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
সংক্রমণ ছড়িয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরেও
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিটওয়ে এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অনেকটা বন্দিশিবিরের মতো অবস্থায় রাখা হয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এই শিবিরে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে।
সিটওয়ের কাছাকাছি ফিউ ইয়ার গোন ও থেট কাল পাইন নামে আরও দু’টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, টিকাদানের প্রস্তুতির জন্য তাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগও করেনি।
থেট কাল পাইন শিবিরের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তিনি নিজে কোভিড-১৯ উপসর্গে ভুগছেন। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতে পারেননি। নু মং নামে ৫১ বছর বয়সী ওই রোহিঙ্গা বলেন, অনেকে অসুস্থ। কয়েকজন মারাও গেছে, যাদের বেশিরভাগই বয়স্ক।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এ পর্যন্ত কতজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন, তা নিশ্চিত করেনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।
মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটসের বিশেষজ্ঞ জও উইনের মতে, মিয়ানমার সরকারের এমন কর্মকাণ্ড বেদনাদায়ক হলেও আশ্চর্যজনক নয়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকারগুলো প্রাপ্তিতে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর বিধিনিষেধের মুখে রয়েছে। উত্তর রাখাইনে আমরা যে রোহিঙ্গাদের কথা বলছি, তারা রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ভয় ও অবিশ্বাস প্রকাশ করেছে। কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করলে কী হতে পারে, তা নিয়ে আতঙ্কিত এসব রোহিঙ্গা।
রয়টার্সের খবর অনুসারে, রাখাইনে আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন শিবিরে ‘বন্দি’। এছাড়া রাজ্যটির অন্য অঞ্চলগুলোতে রয়েছে আরও পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সেখানে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য’ নিয়ে অভিযান চালিয়েছিল মিয়ানমার বাহিনী। অবশ্য এ অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে দেশটি।
যে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লেয়িংয়ের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, সেই ব্যক্তিই আজ দেশটির জান্তা সরকারের প্রধান। সম্প্রতি তিনি নিজেকে মিয়ানমারের নতুন প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা করেছেন। ফলে সামরিক সরকারের অধীনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারপ্রাপ্তি আরও বড় হুমকিতে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিপরীতে, নির্যাতিত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ সম্প্রতি শরণার্থীদের টিকা দেয়া শুরু করেছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে গত মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় ৫৬টি কেন্দ্রে ৪৮ হাজার রোহিঙ্গাকে (যাদের বয়স ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে) করোনা টিকা দেয়া হচ্ছে। একই সময়ে ক্যাম্পের মাঝি (দলনেতা), মসজিদের ইমাম এবং টিকাদানে নিয়োজিত ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবককেও টিকা দেয়া হবে।
মন্তব্য করুন