ডেস্ক রিপোর্টঃ
বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলছে— এমন খবর গত তিন বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখনও এ বিষয়ে বাস্তব কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও নানা নাটকীয়তায় আটকে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। কারণ হিসেবে বরাবরই সামনে আসছে রিক্রুটিং এজেন্সির ‘সিন্ডিকেট’ ইস্যুটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনৈতিক সুবিধালাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় জট খুলছে না সবচেয়ে বড় এ শ্রমবাজারের।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশটিতে মানবসম্পদ পাঠাতে পারবে সব এজেন্সি। এখানে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ বিষয়ে দেশটির (মালয়েশিয়া) সরকারের সঙ্গে শিগগিরই চূড়ান্ত চুক্তি করবে ঢাকা। চুক্তি হলে চলতি বছরের (২০২১ সাল) ডিসেম্বর অথবা নতুন বছরের (২০২২ সাল) শুরুর দিকে আবারও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে বাংলাদেশ।
আরো পড়ুনঃ সিনহা হত্যা মামলায় সপ্তম দফায় প্রথম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মুহূর্তে বিভিন্ন খাতে প্রায় আড়াই লাখের মতো কর্মীর চাহিদা রয়েছে মালয়েশিয়ায়। এ চাহিদা মেটাতে দেশটি কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী নিতে চায়। এজন্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়াও দ্রুত শেষ করতে চায় ঢাকা।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অভিবাসীকর্মী সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়াটি প্রায়ই চূড়ান্ত। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি সম্পন্ন হবে। এবার আর সিন্ডিকেট নয়, ডাটাবেজ ভিত্তিতে কর্মী পাঠানো নিয়ে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করবে। এটি স্বাক্ষর হলেই আমরা কর্মী পাঠানো শুরু করব। আশা করছি, ডিসেম্বর না হলেও জানুয়ারির মধ্যে এটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
আরো দেখুনঃ প্রসঙ্গঃ তৃণমূলের নির্বাচন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, ‘সবকিছু প্রায় ফাইনাল (চূড়ান্ত) হয়ে আছে। কদিন আগেই বিষয়টি নিয়ে মিটিং (বৈঠক) হয়েছে। আমাদের মিশন চাচ্ছে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) দ্রুত সই (স্বাক্ষর) করতে। এটা হয়ে যাবে। এমওইউ সই হয়ে গেলে আমরা আবার নতুন করে কর্মী পাঠানো শুরু করতে পারব।
‘এমওইউ হলে একটা দলিল থাকল। এরপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিতে পারব। এমওইউ না হলে যে আমাদের লোক যাবে না, তা নয়। কিন্তু একটা পেপার থাকলে, দলিল থাকলে ভালো। এক কথায় আইনি একটা বাধ্যবাধকতা থাকল।’
কবে নাগাদ এ চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব মাশফি বলেন, এখনও তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমাদের মিশন চাচ্ছে খুব দ্রুত এটা করে ফেলতে।
কেন বারবার ব্যাহত হচ্ছে শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা>>
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা বারবার ব্যাহত করেছে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি। তাদের তৈরি সিন্ডিকেটের অবৈধভাবে এ বাজার দখলের চেষ্টায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটির বৈঠকে ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দেয় দেশটি।
বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের যুক্তি হিসেবে সে সময় মাহাথির উল্লেখ করেন, জনশক্তি রফতানিতে একতরফা ভেঙে দেওয়া এবং লোক পাঠানের খরচ কমাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখন শুধু ১০টি এজেন্সি বাংলাদেশের লোকজনকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারে। এটি একধরনের একচেটিয়া প্রক্রিয়া।
একচেটিয়া এ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া ভেঙে দেওয়া প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ ব্যবসাকে বাংলাদেশের সব এজেন্টের জন্য খুলে দিতে চাই। এতে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং জনশক্তি রফতানির খরচ কমবে।
পরে অবশ্য ঢাকার কূটনৈতিক তৎপরতায় দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার খোলার আশ্বাস দেয়। এ নিয়ে ঢাকা-কুয়ালালামপুরের মধ্যে বেশ কয়েকবার মন্ত্রী ও সচিবপর্যায়ে সফর বিনিময় এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ পথ আর খোলেনি।
জানা যায়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে সব এজেন্সি— বাংলাদেশ সরকার এ নীতিতে বহাল থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওই সিন্ডিকেট। তারা ভেতরে ভেতরে মালয়েশিয়া সরকারকে এ বিষয়ে নমনীয় করে ফেলে। সিন্ডিকেটটি চাচ্ছে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর দায়িত্ব তাদের হাতেই থাকুক। তবে বাংলাদেশ সরকার কোনোভাবেই সিন্ডিকেটের হাতে এ দায়িত্ব তুলে দিতে চায় না।
২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশিদের জন্য দেশটির শ্রমবাজার খুলে দেওয়া নিয়ে আশার আলো দেখা দেয়। তবে দেশটির ক্ষমতার পালাবদলে সে আলো হঠাৎ নিভে যায়। এরপর করোনাভাইরাসের কারণে ভাটা পড়ে যায় শ্রমবাজার খোলার ইস্যুটি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার বিষয়টি আবারও সামনে আসে। এ নিয়ে ঢাকা-কুয়ালালামপুরের মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘করোনার কারণে গত দুই বছর ধরে নিজেদের শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে মালয়েশিয়া। আমাদের বন্ধ ২০১৮ সাল থেকে।করোনা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। চলতি মাস (নভেম্বর) থেকে ওদের ফ্লাইট চালু হওয়ার কথা। আশা করি এবার শ্রমবাজারটি খুলবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে নতুন নিয়ম চালু হয়। ওই সময় দেশটিতে অভিবাসন শ্রমিক পাঠাতে বাংলাদেশের ১০টি এজেন্সিকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর আগে বাংলাদেশ থেকে যেকোনো রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারত। নতুন ওই প্রক্রিয়ায় গত দেড় বছরে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া গেছেন এক লাখ ৭৯ হাজার ৩৩০ কর্মী। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা ধরলে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৬৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে সিন্ডিকেটটি চার হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নেয় দেড় বছরে।
ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বাংলাদেশের ১০টি জনশক্তি রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান (রিক্রুটিং এজেন্সি) এবং মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইউনিক ইস্টার্ন, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ।
মন্তব্য করুন