মাহবুবুল আলম
আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার সম্বন্ধে মতদ্বৈততা ছিল। এমনটি যে ঘটতে পারে প্রথম প্রথম তিনি তা মোটেই গ্রাহ্য করলেন না। পরে ঠিক সন্ধ্যায় ইপিআর বাহিনীর একজন উচ্চপদন্থ কর্মচারীর মারফতে সংবাদ পেয়ে তাঁর স্নেহের ছাত্র ও বন্ধু-বান্ধব ও নেতাদের ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। ছাত্ররা তাঁকে বাসা ছেড়ে গা-ঢাকা দিতে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি কোথাও যাব না। আমি যদি আত্মগোপন করি, তবে ঢাকা শহর থাকবে না। তারা তন্নতন্ন করে বাড়ি বাড়ি তালাশি চালাবে। বহু বাড়িঘর ও প্রচুর প্রাণহানি হবে।’ তাজউদ্দীনকে বললেন, “তাজউদ্দীন, আমি হয়ত নাও থাকতে পারি। তবে তোমরা কর্তব্যচ্যুত হয়ো না। ইনশাআল্লাহ্, সুফল পাবে, জয় তোমরা করবেই। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।’ তাজউদ্দীন সাহেব চোখের পানি মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলেন। ছাত্ররা সব রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরির কাজে বের হয়ে গেল।বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টায় তাঁর নিজ বাসভবনে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের এক স্বাক্ষাতকারে বলেছেন,‘মুজিব তো চিরকালের পাগল, ভয় তো নেই। ভয় কাকে বলে তা তার জানা নেই। ছোটবেলা হতে সে নির্ভীক। মুজিব জানে সে গ্রেফতার হবে। তাই সে তার বিছানাপত্র গুছিয়ে রেখে মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়েছিল। রাত ১২টায় যখন পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে করতে বাসার গেটের মধ্যে প্রবেশ করল, তখন সে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে তারই ভয়ের দরুন কয়েক মিনিটের জন্য বাথরুমে গিয়ে দাঁড়ায়। পাকবাহিনী যখন নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে, তখন সে বের হয়ে তাদের সামনে এসে তাদের ধমক দেয়। বলে,‘অনর্থক গালি দিচ্ছ কেন? আমার লোকদের হত্যা করো না। আমাকে চাও, আমি হাজির, চলো, কোথায় নিয়ে যাবে।’ তখন তারা তাঁকে গাড়িতে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার প্রসঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং নিকট আত্মীয় মমিনুল হক খোকা সেই দিন দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন। ২৫ মার্চ গ্রেফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘রাত বাড়ার সাথে সাথে দর্শনাথীরা অনেকেই বিদায় নিয়েছে। হঠাৎ দেখি ক্যাপ্টেন রহমান, পূর্ব পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর পাকিস্তান নেভির দুজন প্রাক্তন বাঙালি কর্মকর্তা কমান্ডার ফারুক, তিতাস গ্যাসের তদানীন্তন জেনারেল ম্যানেজার এবং লে. মতিউর রহমান উপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে কিছুক্ষণের মধ্যে তারা চলে গেলেন। এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে। মিয়াভাইর নির্দেশে আমি টেলিফোন ধরলাম। ওপাশে রাজ্জাক ‘ ইপিআর-কে ডিসআর্মড করা হয়েছে’ বলতে না বলতেই লাইন কেটে গেল।’ বঙ্গবন্ধুর সহযোগীরা তাঁকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হননি। তবে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা চলে যেতে চাও তাড়াতাড়ি চলে যাও’ বলে সম্মতি দিয়েছিলেন। পাকসেনাদের অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অনেকেই আত্মগোপনে যাত্রা করেছিলেন।এপ্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের এক স্বাক্ষাতকারে বলেছেন,‘মুজিব তো চিরকালের পাগল, ভয় তো নেই। ভয় কাকে বলে তা তার জানা নেই। ছোটবেলা হতে সে নির্ভীক। মুজিব জানে সে গ্রেফতার হবে। তাই সে তার বিছানাপত্র গুছিয়ে রেখে মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়েছিল। রাত ১২টায় যখন পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে করতে বাসার গেটের মধ্যে প্রবেশ করল, তখন সে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে তারই ভয়ের দরুন কয়েক মিনিটের জন্য বাথরুমে গিয়ে দাঁড়ায়। পাকবাহিনী যখন নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে, তখন সে বের হয়ে তাদের সামনে এসে তাদের ধমক দেয়। বলে,‘অনর্থক গালি দিচ্ছ কেন? আমার লোকদের হত্যা করো না। আমাকে চাও, আমি হাজির, চলো, কোথায় নিয়ে যাবে।’ তখন তারা তাঁকে গাড়িতে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার প্রসঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং নিকট আত্মীয় মমিনুল হক খোকা সেই দিন দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন। ২৫ মার্চ গ্রেফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘রাত বাড়ার সাথে সাথে দর্শনাথীরা অনেকেই বিদায় নিয়েছে। হঠাৎ দেখি ক্যাপ্টেন রহমান, পূর্ব পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর পাকিস্তান নেভির দুজন প্রাক্তন বাঙালি কর্মকর্তা কমান্ডার ফারুক, তিতাস গ্যাসের তদানীন্তন জেনারেল ম্যানেজার এবং লে. মতিউর রহমান উপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে কিছুক্ষণের মধ্যে তারা চলে গেলেন। এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে। মিয়াভাইর নির্দেশে আমি টেলিফোন ধরলাম। ওপাশে রাজ্জাক ‘ ইপিআর-কে ডিসআর্মড করা হয়েছে’ বলতে না বলতেই লাইন কেটে গেল।’ বঙ্গবন্ধুর সহযোগীরা তাঁকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হননি। তবে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা চলে যেতে চাও তাড়াতাড়ি চলে যাও’ বলে সম্মতি দিয়েছিলেন। পাকসেনাদের অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অনেকেই আত্মগোপনে যাত্রা করেছিলেন।এ প্রসঙ্গে করাচি ‘মনির্ং নিউজ’ পত্রিকার সংবাদদাতা অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার লেখায় যে বিবরণ দেন তা ছিল এমন-‘…ভাগ্যবিড়ম্বিত সেই রাতে আটটার সময় নাম না জানা এক রিক্সাচালক দ্রুত পায়ে প্যাডেল চালিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে এসে থামে চালক হাঁপিয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্য জরুরি বার্তা বহন করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এত পথ সে রিক্সা চালিয়ে এসেছে। বাংলায় বার্তাটি ছিল সংক্ষিপ্ত: ‘আজ রাতে আপনার বাড়িতে হামলা হবে।’ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ডেকে তিনি বার্তার কথা জানান এবং তখনই সবাইকে ছড়িয়ে পড়তে ও আত্মগোপনে চলে যেতে বলেন। নিজে আত্মগোপন না করা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জনগণকে রক্ষা করবার ছিল। আমি যদি সেখানে না থাকতাম তবে আমার খোঁজে ইয়াহিয়া খান গোটা শহর জ্বালিয়ে দিত’ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,That evening my house was sorrunded by commandos and they wanted to kill me if I came out of my house, giving the name of my own people and saying that Mujib Rahman has been killed by his extremists of Bangladesh. Then they decided to take action by telling the world that we are negotiating with Mujibur Rahman and that Yahiya Khan has no alternative but to take action against that. That was their first idea. I know they are brutes, uncivilized. They will kill my whole people. They will make a massacres. I thought it is better I die and at least save my people who love me so much. ’
বঙ্গবন্ধু অনেকটা নিশ্চিত হয়েই পরিবারের সন্মন্ধে কি করণীয় তা যথাযথভাবেই করেছিলেন। সে ভাগ্যবিড়ম্বিত রাতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা, দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানা ও তিন পুত্রের দুইজন। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন তাকে ছেড়ে ফজিলাতুন্নেছা কিছুতেই কোথাও যাবে না। তবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সরাবার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। শেখ হাসিনা ছিল তখন সন্তানসম্ভবা। তাদের দ্রুত বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন ছিলেন স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। সেই রাতে শেখ কামাল ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিলেন না। নিজের সাথে রেখে দিলেন স্ত্রী ও দুই পুত্রকে। তিনি ভাবলেন একটি দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পালিয়ে যেতে পারে না। সেই রাতে এত উত্তেজনার মাঝেও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় এরিনমোর তামাকের পাইপ টানছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর জন্য যা যা করণীয় তা তিনি ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন।
ইপিআর ব্যারাক প্রথমেই আক্রান্ত হয়েছে এবং ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের ডিসআর্মড করা হয়েছে এটা তিনি আগেই জেনেছেন। এবং অবগত হয়েছেন রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রান্ত ও প্রতিরোধের খবর। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তখনও কিছু জানতেন না। এমনই এক পরিস্থিতিতে উদ্বেগাকুল বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের এক ঘনিষ্ঠলোকের কাছে সর্বত্র প্রচারের জন্য তখন স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক ছোট্ট বার্তাটি পড়ে শোনান। আগেই বলা হয়েছে সেই সংক্ষিপ্ত বার্তাটি ছিল এরকম:‘মধ্যরাতে পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ও পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। এদের প্রতিহত করতে শক্তি সঞ্চয় করুন এবং প্রস্তুত হোন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য।’বঙ্গবন্ধুর বাসায় তখন তিনজন পরিবারের সদস্য ছাড়া তাঁর নিরাপত্তার জন্য যে দু-জন দলীয় দেহরক্ষী রয়েছে পাকিস্তানী আর্মিরা এলে তাদের কিছুই করার থাকবে না। তাই তিনি তাদের ডেকে চলে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত রাজা ও মহিউদ্দিন চলে যাওয়ার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। তারা যেতে না চাইলে বঙ্গবন্ধু স্বভাববিরুদ্ধ ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমি তোমাদের চলে যেতে আদেশ করেছি’। এর পর বাসার কাজের মহিলা রানাকে নম্রকণ্ঠে বোঝালেন এখানে থাকাটা বিপজ্জনক হবে। কিন্তু সেও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিপদের মুখে ফেলে চলে যেতে অস্বীকার করলো। এর পর তিনি প্রবেশ করলেন তাঁর রিডিংরুমে। তিনি কয়েকটি বইয়ের পাতা উল্টালেন তারপর তা রেখে ডায়রিতে কিছু লিখলেন।সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের এক গুরু দায়িত্ব পেয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর বিলাল। দায়িত্ব পেয়েই দ্রুত সে কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন।তার অধীনে ছিল একটা ট্যাঙ্ক, একটা এপিসি এবং কয়েক ট্রাক ভর্তি সৈনিক। তিনি যথা সময়েই তার দলবল নিয়ে রওয়ানা দিলেন ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়েই তিনি ও তার দলবল সম্মুখীন হলো বিরূপ পরিস্থিতির। পথে পথে ব্যারিকেড এবং ব্যারিকেড। এসব অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের এসে সবাই থামল। সেই বাড়ির দিকে তাক করে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঝড়ের মতো গুলি চালাতে লাগল।সন্ধ্যার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের বিদায় করে তিনি একরকম তৈরিই ছিলেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গোলা ছোড়া ও অতর্কীতে আক্রমণে তিনি মোটেই ঘাবড়ে যাননি। তবে এ কাপুরোষচিত হামলার জন্য রেগে ওঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেলকনিতে বের হয়ে এসে বললেন, ‘হ্যা আমি তৈরি। তোমাদের গুলি ছোঁড়ার কোনো দরকার নেই।’ একজন অফিসার তখন এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।’ কিন্তু সৈনিকদের অনেকেই অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে লাগল। তারা তাঁকে ধরে ফেলল। টেনে নিয়ে চলল এবং মাথার পেছন দিকে কিল ঘুষি মারতে লাগল। কেউ কেউ বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করতে লাগল। তারা বঙ্গবন্ধুকে টেনে হিচড়ে নিচে নামাল। বঙ্গবন্ধু তখন তাদের বলেছিলেন, ‘দাড়াও, আমাকে আমার পাইপ ও তামাক এবং স্ত্রীকে বিদায় জানাতে দাও।’ বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে ডেভিট ফ্রস্টের সঙ্গে এক সাক্ষৎকারে বলেছেন,‘পাইপ ও তামাক নিয়ে …বিদায় নিলাম আমার স্ত্রীর কাছ থেকে। …তিনি একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। আমি তাকে চুমু দিলাম, বিদায়ী চুম্বন এবং তারপর আমি বের হয়ে আসি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমরা এখন গোলাগুলি বন্ধ করতে পারো। আমি এখানে রয়েছি। …তোমরা কি জন্য এমন গুলি ছুঁড়ছ? এরপর তারা চারিদিক থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। …আমাকে আবারো আক্রমণ করতে। তখন হঠাৎ করে, সেখানে উপস্থিত একজন অফিসার, আমাকে বেষ্টন করে ধরল এবং বলল, এঁকে হত্যা করো না।নেমে আসার পর পেছন ফিরে দেখলাম আমার স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি তখন চারিদিকে আগুন দেখতে পাচ্ছিলাম। চারিদিক থেকে মর্টারের গোলা বর্ষণের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম।’গ্রেফতারের পর বঙ্গবন্ধুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এ প্রসঙ্গে টিক্কা খানের এডিসি মেজর (অব.) এস.জি জিলানি বলেছেন, ‘গ্রেফতারের পর শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। কেননা, তিনি ছিলেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বন্দী। কিন্তু তার এ অবস্থানের কথা অন্য কারো জানা ছিল না। নিরাপত্তার খাতিরে তাঁকে এক জায়গাতে রাখা হতো না। পাকিস্তানে উড়িয়ে নেয়ার আগে আজ এখানে তো কাল ওখানে এই করতে করতে শেষ পর্যন্ত তিন দিন পর ২৯ মার্চ ১৯৭১ বন্দি বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন।বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে সাংবাদিক আমীর তাহেরি টিক্কা খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরে টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলছিল, ‘স্যার শুনুন। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।’ আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি।’…তাই শেখকে গ্রেফতার করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না।’ আমীর তাহেরি আবার যখন জানতে চাইলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে চলে যেতেন তবে সে ক্ষেত্রে আপনি কি করতেন স্যার?’ এই প্রশ্নের জবাবে টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি খুব ভালো করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তাঁর জনগণকে ছেড়ে কোথায় যাবেন না। যদি সে আত্মগোপনেই চলে যেত তা হলে তাকে তন্ন তন্ন করে ঢাকা শহরে খুঁজে বেড়াতাম এবং শহরের একটি বাড়িও তল্লাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তাঁর মতো অন্য নেতাদের গ্রেফতারের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তারা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন।’বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের ঘটনা প্রসঙ্গে মেজর সিদ্দিক সালেক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তখন প্রথম গুলি বর্ষণ করা হয় তখন রেডিও পাকিস্তানে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো পূর্বে রেকর্ডকৃত বাণী। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। …এর কিছুক্ষণ পরই ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর তার বেতার কণ্ঠ শুনতে পেলেন, বিগ বার্ড ইন দ্য কেজ।’
২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে পালিয়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি তার হানাদার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন বাঙালিদের নিধন এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে বন্দি করে নিয়ে যাবার জন্য। সেই নির্দেশ মতোই পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে আনুমানিক ১১ টায় নিরস্ত্র অসহায় ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর সকল পাশবিক শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী। তারা নির্বিচারে অসহায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালালো মর্টার সেল, ট্যাঙ্ক ও মেশিনগানের গুলি। হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসকে শুধু নিরস্ত্রই করেনি হত্যা করেছে শত শত ইপিআর ও পুলিশ সদস্যকে। পঁচিশে মার্চ সে কালরাত্রিতেই এমনিভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করে লক্ষাধিক বাঙালিকে।এ বর্বরোচিত হামলার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ওয়ারলেস মেসেজের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। বঙ্গবন্ধুর ওয়ারলেস মেসেজে পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণার বাণীটির বাংলা অনুবাদটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:‘‘বাঙালি ভাই-বোনদের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে আমার আবেদন, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প ও পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে রাত বারটায় পাকিস্তানী সৈন্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে আমরা লড়ে যাচ্ছি। আমাদের সাহায্য প্রয়োজন এবং পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকেই হোক। এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করছি। তোমরা তোমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে মার্তৃভূমিকে রক্ষা কর। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।’’-শেখ মুজবুর রহমান(শামছুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন থেকে উদ্ধৃত)বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এ ম্যাসেজটি কীভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা বর্ণনা করেছেন ঘোষণাটি প্রচারের সাথে সম্পৃক্ত প্রকৌশলী মেজবাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বর্তমানে সৌদিআরবে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান প্রযুক্তি প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত আছেন। তাঁর এ বক্তব্য নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে মেজবাহউদ্দিনের তাঁর বর্ণনা করা যায় এভাবেই:বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদারদের পৈচাশিক আক্রমনে বাঙালিরা যখন শোক বিহ্বল ও দিশেহারা, ঠিক সেই সময়ই সারা বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ, আনসার, ইপিআর ছাত্র জনতা বঙ্গবন্ধুর ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেল করতে হবে’ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। দেশের কোনো কোনো শহরাঞ্চলে বিভিন্নজনের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার হ্যান্ডবিল। এই হ্যান্ডবিল পেয়ে শোকবিহ্বল হতাশগ্রস্ত সাধারণ মানুষ যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠল। হ্যান্ডবিলে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক বাণীটি প্রচার করার ব্যবস্থা করতে ডাক্তার মন্জুলা মাওলা, তার স্বামী আনোয়ার আলী, ওয়াপদার প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম ও মি. দিলীপ, বেতারের শিল্পী বেলাল মোহাম্মদ, এবং ফটিকছড়ি কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ কয়েকজন কুশীলব চট্টগ্রামের রেডিও স্টেশনে ছুটে যান। এর পূর্বেই চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হান্নান অপরাহ্ন দুইটায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণীটি নিজের কণ্ঠে প্রচার করেন। সেখানে নিরাপত্তাহীনতার কারণে চট্টগ্রাম কালুরঘাট টান্সমিটারে তা প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠিত বিপ্ল¬বী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪০ ঘটিকায় অনুষ্ঠান শুরুর কিছু পরেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদটি উপস্থাপন করেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। আবার পরদিন ২৭ মার্চ সান্ধ্য অধিবেশনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করলেন মেজর জিয়াউর রহমান। মেজর জিয়ার সে দিনের ঐতিহাসিক ঘোষণাটি তাঁর স্ব-কণ্ঠে বাণীবদ্ধকৃত টেপ থেকে পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে তুলে ধরা হলো:
The government of the sovereign state of Bangladesh on behalf of our great leader, of supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, We hereby proclaim the independence of Bangladesh, and government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of seventy five Million people of Bangladesh, and the government headed by him is the only legitimate government of the people of the Independent sovereign state of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed and is worthy of being recognised by all of the governments of the world.
I therefore, appeal on behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democratic countries of the world, specially the big powers and the neighbouring countries to recognise the leagal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. To dub out the legally elected representative of the majority of the peoples as secessionist is a crude joke and contradiction to truth which should be fool none.The guiding principle of the new state will be first neutrality, second peace & third firendship to all enemity to none. May Allah help us. joy Bangla.
(রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সাভিস কর্তৃক সংরক্ষিত মেজর জিয়ার স্বকণ্ঠ ভাষণের অডিও টেপ থেকে উদ্ধৃত)বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের এ ঘোষণা শুনে বাঙালিরা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এরপর মেজর জিয়াউর রহমানের আরো দুটি ভাষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল ২৮ ও ৩০ মার্চ। ৩০ মার্চ জিয়াউর রহমানের ভাষণের কিছুক্ষণ পরেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বোমা হামলায় তা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে
মুক্তিযুদ্ধ। এমতাবস্থায় ২৯ মার্চ পাকিস্তানের এক সামরিক বিমানে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধ। পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সৈনিকসহ ছাত্র-তরুণের সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখসমর। ২৬ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, সেনা ছাউনিগুলোতে। সামরিক ও অসামরিক যোদ্ধাদের সমন্বয়ে নতুন রূপ নেয় স্বাধীনতার যুদ্ধ।
লেখ: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
ডেট্রয়েট, মিশিগান, ইউএসএ
মন্তব্য করুন