সন্তানের জন্য বাবা হওয়া উচিত বন্ধু অন্যদিকে মা হওয়া উচিত বান্ধবী


দ্যা সিলেট পোস্ট প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১০, ২০২৪, ১১:১৭ অপরাহ্ন /
সন্তানের জন্য বাবা হওয়া উচিত বন্ধু অন্যদিকে মা হওয়া উচিত বান্ধবী

মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী

৯ ফেব্রুয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত একুশের বইমেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য ইন্ডাইরেক্টলি তিশার মা-বাবা দায়ী। সেদিন আমি বই মেলার ঘটনাস্থলে থাকলেও ঘটনাস্থলে তরুণদের প্রচন্ড ভিড়ের কারণে প্রচুর ধুলাবালি উড়তে থাকায় তিশা-মুশতাককে বইমেলা থেকে চলে যেতে বাধ্য করার পরিস্থিতি তথা গন্ডগোলের সেদিক এড়িয়ে চললেও দূর থেকে অবলোকন করি। মিথ্যাবাদী মোস্তাক পরে লাইভে এসে বলে তিনি নাকি স্বেচ্ছায় তার স্ত্রী তিশাকে নিয়ে মেলাস্থল ত্যাগ করে চলে আসেন।

ঘটনাটা আসলেই দুঃখজনক। তিশা মেয়েটি ছোটকাল থেকে শুরু করে মুশতাক এর সাথে পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে-এরকম মনে হচ্ছে না।

তিশার মা-বাবা তিশাকে কড়াকড়ির মধ্যে রেখেছিলেন।মা-বাবারা সন্তানদেরকে, সন্তানদেরই ভবিষ্যতের স্বার্থে কড়াকড়ি করে থাকেন এবং সন্তানরাও তা মেনে নেয়। তিশাও মেনে চলে আসছিলো। সমস্যা ছিল না কিন্তু তিশার মা-বাবারঝগড়াঝাটি তিশার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়াসহ তার মস্তিষ্কে বিভিন্ন রকম ঝড় উঠে। আর তাই সে তার মা-বাবার সাংসারিক জীবনকে ঘৃণা করে আসছিলো। ঘৃণা করলেও সে মোশতাক এর মতো কাউকে বিয়ে করার চিন্তা মাথায় আনতো না। কিন্তু তিশার মা-বাবা যখন তাকে বিভিন্নভাবে অবজ্ঞা করে আসছিলেন-তখন সে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়।তিশা একটা লাইভে বলেছে যে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে সে তার মা-বাবার ঝগড়াঝাটি দেখে আসছে। তার মা-বাপ সাংসারিক জীবনে মোটেও সুখী নয়। তার বাবা কর্তৃক তার মাকে মারধর করাসহ তার বাবার বিভিন্ন আচরণে সে অসন্তুষ্ট।

সে লেখাপড়ার জীবনে সব পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে আসলেও তাকে তার মা-বাবা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোথাও বেড়াতে না নিয়ে যাওয়া। পরীক্ষার পর অবসরে তাকে যখন গল্প কিংবা উপন্যাস বই পড়তে তার বাপ দেখতো তখন তার বাপ কর্তৃক বই ছিঁড়ে ফেলা। এরকম আরো নানাবিধ ঘটনার কারণে সে তার বাবার মতো স্বভাবের পুরুষদের বিষয়ে নেতিবাচক হয়ে উঠে।

কোনো ছেলের সাথে তিশার সম্পর্ক না থাকায়, তার কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য মোস্তাকের মিষ্টি কথায় প্রলুব্ধ হয়ে,প্রশ্রয় পেয়ে (প্রশ্রয় দেওয়া মোস্তাকের উচিত হয়নি), মোস্তাককে আদর্শ পুরুষ মনে করে, মা-বাবাকে শিক্ষা দিতে, মা-বাবার সাথে পেরে উঠার জন্য টাকাওয়ালা মোস্তাক হলে সেটা পারবেন এবং বয়স কম হওয়ায় আবেগের বশবতী হয়ে সে মোস্তাককে বিয়ে করে ফেলে।

কারণ যা-ই হোক বিয়ে তো হলো। তা মেনে নিতে তার মা-বাবার আপত্তি থাকলেও ধর্মীয় কিংবা সামাজিকভাবে মেনে না নেওয়ার কিছু ছিল না। এরকম বয়সের বিশাল তফাৎ এর বিয়ে সাবেক রেলমন্ত্রীসহ অনেকেই করেছেন। আর তাই সমস্যা ছিল না। তাছাড়া মোস্তাক-তিশার বিয়ে আদালতের মাধ্যমেও মানামানি হয়ে যায়।তাদের নতুন সংসার বয়সের বিশাল তফাৎ (৬৫ বনাম ১৮) সত্ত্বেও ঠিক মতো চলছিল।

কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করে খন্দকার মোস্তাক নিজেই। তার নতুন বউ গত রমজানে রোজা রাখা অবস্থায় কাজী অফিসে আকদ হওয়ার পর পরই তাকে পায়ে ধরে সালাম করলো বলে খন্দকার মোস্তাকই লাইভে প্রকাশ করে। তারমানে তিশা মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট স্বামী ভক্ত ও স্বামীর অবাধ্য হওয়ার নয়-এটা পরিষ্কার বুঝা যায়। এই তিশাকে মিডিয়ায় শো-আপ করার বুদ্ধিটা তিশার নয়-এটা খন্দকার মোস্তাকেরই। যদি তিশার হয়েও থাকে, যেহেতু তিশা মোস্তাককে খুবই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে-সেহেতু মোস্তাক ‘না’ বললে তিশা মানতো এবং মিডিয়ায় খারাপভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতো না। মিডিয়ায় সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে মোস্তাকের যে ইন্ধন রয়েছে -সেটা তিশাকে নিয়ে তার লেখা বই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয়গুলো তুলে ধরার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এসবের দ্বারা মোস্তাক সমাজকে নিশ্চয়ই কোনো ভালো ম্যাসেজ দিচ্ছেন না।

মোস্তাকের মেয়েও তার নতুন মা ও বাপকে নিয়ে লাইভে তার বাপের কাজটি সঠিক এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তার মেয়ে এটা কি নিজ থেকে করেছে? নিশ্চয়ই নয়। তাকে দিয়ে খন্দকার মোস্তাক করিয়ে নিয়েছেন। লাইভে মোস্তাক ও তিশা তাদের একান্ত স্বামী-স্ত্রী সুলভ খুনসুটিগুলোও প্রকাশ করে দেখানোটা তাদের নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশ।

৯ ফেব্রুয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একুশের বই মেলা থেকে বেহায়া এই দম্পতিকে তরুণ সমাজের একটা বৃহৎ অংশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বই মেলা থেকে তারা দুইজনকে বের করে দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করাটা দুঃখজনক হলেও সেটা তাদের প্রাপ্য ছিলো।

তিশা মোস্তাককে কখনো বিয়ে করতো না-যদি তিশার মা-বাবা ভুল না করতেন। আমি এভাবে মন্তব্য করতে পারছি এজন্যই যে কিছু দিন পূর্বে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে তিশা যখন ক্লাস সিক্সে পড়তো তখন থেকে তার মা-বাবাকে পারিবারিক অশান্তির মধ্যে দেখে আসছিলো বলে তিশা জানিয়েছিল।

মা-বাবার আচরণ সন্তানদের উপর প্রভাব পড়ে। তাছাড়া তিশার মা-বাবা একদম বেবী থেকে তিশাকে যেভাবে আদর যত্ন করে আসছিলেন-সেরকম আদর যত্ন যতো বড় হবে-স্বাভাবিকভাবে কমবে৷ কিন্তু সেটা এমনভাবে কমা ঠিক নয়-যাতে সন্তান (তিশা) মা-বাবাকে ভুল বুঝে।

আমাদের সমাজে দেখা যায়, বেবি থেকে ১০/১১ বছর পর্যন্ত মা-বাবাদের সন্তানের প্রতি টেইক কেয়ার এর কোনো ধরনের কমতি থাকে না। সন্তান যতোই বড় হবে অবশ্যই টেইক কেয়ার কমাতে হবে। কিন্তু তাই বলে গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগির চেয়েও টেইক কেয়ার কমিয়ে দেওয়া কি ঠিক?কিছু কিছু অভিভাবক (টেইক কেয়ার) এতই কমিয়ে দেয় যে, গৃহপালিত পশুর প্রতি যে টেইক কেয়ার সেটার চেয়েও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কম।

ঐশী রহমান যখন সেভেন-এইটে পড়ছিলো, কার সাথে মিশছিলো, কী করছিলো, কোথায় যাচ্ছিলো, তার খাবার-দাবার কী ভাবে চলছিলো-এসব বিষয়ে কোনো খবরা-খবর না রাখায় (অথচ বাসায় গৃহপালিত পশু-পাখীদের খবর রাখতো তারা) ঐশী, ঐশী (নষ্ট) হয়ে তার মা-বাবাকে খুন করে। গাঁজা, মদ, ইয়াবা এসবে ঐশী রাতারাতি তো আর আসক্ত হয়ে যায়নি? দীর্ঘ সময় নিয়ে সে এরকম খারাপ হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়ে মা-বাপ কোথায় ছিলো? যে ঐশীর জন্য তার মা-বাপ বেবী থেকে শুরু করে ১১/১২ বছর পর্যন্ত কতো আদর যত্ন, টেইক-কেয়ার, মুহুর্তে মুহূর্তে খবর রাখা এসব করতো। বড় হলে কমবে, স্বাভাবিক কিন্তু গৃহপালিত পশুর চেয়ে কম? কতো লক্ষ হাঁস-মুরগি, গরু ছাগল এক জায়গায় করলে প্রাণের টুকরো সন্তানের সমান হবে? এরকম সন্তান যদি অভিভাবকের যথাযথ তদারকির অভাবে ঐশী (চূড়ান্ত নষ্ট) হয়ে যায়। তারজন্য শুধুমাত্র ঐশী কি দায়ী? তার মা-বাবাও কি দায়ী নয়?

মা-বাবার স্নেহ-যত্ন সন্তানের জন্য সন্তান বড় হলেও দরকার তথা আজীবন দরকার। অন্যদিকে সন্তান মা-বাবাকে সুখে-দুঃখে সাহায্য করার পর্যায়ে উপনীত হলে সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য মা-বাবাকে সহায়তা করা। ছোট থেকে সন্তান বড় হতে থাকলে মা-বাবার উচিত সন্তানদের দিয়ে এরকম কাজ করিয়ে নেওয়া। যদি তা না করা হয়-তাহলে দায়িত্ববোধ সন্তানের মধ্যে জন্মাবে না। আমি দেখেছি, যেসব মা-বাবারা অতি আদর করে সন্তানদের কোনো কাজ করতে দেন না-তারা পরে মা-

বাবার জন্য জরুরি কাজগুলো করতে বললেও করে না। অতিরিক্ত আদর সন্তানের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে। তাছাড়া কিছু কিছু মা-বাপ সন্তানেরা দোষ করলেও প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। আর তাই অতিরিক্ত আদর ও প্রশ্রয় সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়।

অন্যদিকে অতিরিক্ত শাসনও ক্ষতি বয়ে আনে। আদর ও শাসন দুইটির সমন্বয় করে চলতে হবে। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।

মা-বাবার উচিত সীমারেখার মধ্যে সন্তানদের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করা। একজন সন্তানের জীবনে বাবা হওয়া উচিত শ্রেষ্ঠ বন্ধু অন্যদিকে মা হওয়া উচিত শ্রেষ্ঠ বান্ধবী। এরকম সবার ক্ষেত্রে হওয়া উচিত।

তিশা তার মায়ের সাথে যদি বান্ধবীর মতো হতে পারতো কিংবা তার মা-বাপ তাকে এরকম পরিবেশ দিতো তাহলে খন্দকার মোস্তাকের সাথে সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার আগেই তার মা অবশ্যই জানতেন, সে তার মাকে জানাতো।

প্রতিটি পরিবারে নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক হওয়া উচিত। এতে করে পরিবারের সদস্যদের মাঝে দূরত্ব লাঘব হয়ে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়ে একে অন্যের মানসম্মান হানির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না এবং পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের দোষত্রুটি পরিমার্জনে সহায়ক হয়ে আদর্শ পরিবার গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারবে।

পরিবারে, সমাজে সবক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় চলছে। এরজন্য আমরা সকলেই বেশ আর কম দায়ী। প্রত্যেকে অন্যকে দায়ী না করে নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তিশার মা-বাবা যদি তাদের সাংসারিক জীবনে আদর্শ পরিবারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যদি সংসার পরিচালনা করতেন তাহলে তিশা বর্তমান অবস্থায় পতিত হতো না। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।