কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ঈদকে সামনে রেখে উপজেলার মণিপুরি তাঁত পল্লীগুলোকর্মমুখর হয়ে উঠেছে। ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত শিল্পীরা। এদিকে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কমলগঞ্জ উপজেলা মণিপুরি তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।
প্রতিদিন এখানে বেড়াতে আসা শত শত পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় মণিপুরি তাঁতের শাড়ি, থ্রিপিস, চাঁদর, পাঞ্জাবিসহ রকমারি পোশাক। শুধু তাই নয়, অনলাইনে ব্যবসায়ীরাও এখান থেকেই তা সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে ঈদ ও পূজা-পার্বণে এসব পোশাকের চাহিদা বেড়ে যায়। ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে মণিপুরি তাঁতপল্লীর বুননশিল্পীদের। বর্তমানে বিকল্প জীবিকা ও পুঁজির অভাবে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পরিবার এই পেশা থেকে সরে এসেছে।
মণিপুরি একেকটা ঘর মানেই একেকটি তাঁতশিল্পের কারখানা। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন উপজেলার সহ¯্রাধিক মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোক। বিশেষ করে মণিপুরি নারীরা কাপড় বোনেন এবং পরুষেরা বিপণন ও কাঁচামালের জোগাড় করেন।
জানা যায়, মণিপুরি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিটি ঘরই যেন তাঁত শিল্পের একেকটি ছোট কারখানা। কমলগঞ্জ উপজেলার রানীরবাজার, ঘোড়ামারা, আদমপুর, তিলকপুর, ভানুবিল, মাঝেরগাঁও, তেতইগাঁও, মাধবপুর, শিববাজার, ঝাঁপেরগাঁও, গোলেরহাওর, ইসলামপুর, কোনাগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় মণিপুরি সম্প্রদায়ের শতকরা ৯০ ভাগ নারী ও পুরুষ তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিপুন হাতের তৈরি তাঁত বস্ত্র ঈদ ও পূজা পার্বনে ফ্যাশন সচেতন মানুষের কাছে সমাদৃত। করোনা অতিমারির কারণে দীর্ঘ বিগত দুই বছর তাঁত শিল্পে চরম লোকসান গুনতে হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ায়, ঈদকে সামনে রেখে কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত মণিপুরি তাঁত শিল্পীরা। তবে, রং ও সুতাসহ উপকরণের দাম বাড়ায়, লাভ কম হবে বলে জানান তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা। নানা প্রতিকূলতার মাঝে টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। সরকারি প্রণোদনা না পেলে তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
মণিপুরি সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ বলেন, ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি তাঁতের কাপড় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কমলগঞ্জসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মণিপুরি তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র।
বাংলাদেশ ব্যাংক চালু করেছে এসএমই ঋণ প্রকল্প। এসব কেন্দ্র থেকে প্রায় সব মণিপুরি পরিবার থেকেই নারীরা তাঁতের কাপড় তৈরি শিখে নিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন মণিপুরি তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত কমিউনিটির উদ্যোক্তারা। তিনি বলেন, শুধু প্রশিক্ষণ প্রদান ও তাঁত ঋন দিলেই চলবে না, সর্বাগ্রে প্রয়োজন মণিপুরি কাপড়ের কাঁচামাল সহজলভ্য করা।মণিপুরি উদ্যোক্তা ভুবন সিংহ বলেন, এখন সরকারিভাবে বিনা সুদে প্রণোদনা কিংবা আর্থিক সহযোগিতা জরুরি। তা না হলে নিজস্ব উদ্যোগে তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
মণিপুরি কমিউনিটির নারী নেত্রী সৌদামিনী শর্মা বলেন, একটু সহযোগিতা পেলেইএই শিল্প দিয়েই এখানকার মানুষগুলো বেঁচে থাকতে পারবে। তেমনি সরকারও পাবেরাজস্ব। তিনি আরও বলেন, একটি সাধারণ শাড়ির কাঁচামাল সংগ্রহে খরচ পড়ে ১হাজার টাকা। আর উন্নত সুতা দিয়ে তৈরি করলে সেই খরচ পড়বে ২ হাজার টাকারও অধিক। আর মণিপুরি জামদানি তৈরি করলে তার খরচ পড়ে প্রায় ৪ হাজার টাকা। মণিপুরি হ্যান্ডিক্রাফটসের স্বত্ত্বাধিকারী এন প্রদীপ কুমার সিংহ জানান, এই শিল্পের বিশ্বব্যাপী প্রসার ও তাঁতীদের রক্ষার জন্য সুদের হার কমিয়ে প্রকৃত তাঁতীদের আরও বেশি করে ঋণ দিতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য তাঁতশিল্পীরা জানান, দেশ-বিদেশে বাহারি মণিপুরি পোশাকের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। তাই সবার আগে কাঁচামাল প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বলেন, এই অঞ্চলে মণিপুরিতাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর চাহিদা রয়েছে। এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কমলগঞ্জে প্রশিক্ষণ সেন্টার তৈরি করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন