ড. নিলুফা আকতার
নোবেল পুরস্কার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে! অনেকে এ পুরস্কারকে সুখ অনেকে আবার অসুখ হিসাবে দেখছেন। অথচ বিচিত্র পুরস্কারের চেয়ে আরও কঠিনতম অসুখে আমরা ভুগছি! তা হলো নানা ধরনের দৌরাত্ম্যবৃত্তি। এই দুর্বৃত্তায়ন সমাজের দুটো জায়গাকে দূষিত করে ফেলেছে।
এক.বিদ্যাপীঠ দুই. সাহিত্যাঙ্গন। দুটোই তীর্থস্থান মানবিক মানুষ গড়ার প্রথম আঁতুড় ঘর। শ্রেণিকক্ষে জুজুর ভয়ে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা , শিক্ষকদের দলবাজির গেঁড়াকলে শিক্ষার্থী, নম্বরপ্রাপ্তির, ভবিষ্যৎ শিক্ষক হবার স্বপ্নের সোনার হরিণের সম্মোহনে শিক্ষার্থী, একসময় মগজ ধোলাইয়ে অন্ধ শিক্ষার্থী, শেষপর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে আসা আত্মবিশ্বারের শেষ কপাটটাও বন্ধ। এই টানাহেঁচড়ার পাঠদান ও পাঠগ্রহণ হয়ে যায় শুভঙ্করের ফাঁকি! তারপর একসময় হতাশায় নিমজ্জ্বিত শিক্ষার্থী তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিভ্রান্ত মন, অনুশোচনা নিয়ে পথে নেমেছে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। অথৈই সমুদ্রে তরী টলমল, অথচ কাণ্ডারী তো ছিল শিক্ষক-ই। লক্ষ্য নিয়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়ে চরম দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে জীবনবাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে তারা! এই অমোঘ নিয়তি থেকে মুক্তির পথ অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, উদ্ধারের পথ কী আদৌ আছে? ঈশ্বরচন্দ্র, রামমোহন রায় অমরলোকে গিয়ে বেঁচে গেছেন! আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছি, একে অন্যের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করছি কী ভয়ানক ভূমিকায় আমরা অবতীর্ণ হয়েছি? শিক্ষক-শিক্ষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমন কী দলগত শিক্ষার্থী এবং দলছুট শিক্ষারীদের সম্পর্ক এক কিম্ভুতকিমাকার অবস্থায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে!! একবার কী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের চেহারাটা দেখছি?
লেখকের ক্ষেত্রে, একজন ভালো লেখক কিন্ত তাকে নিয়ে বোদ্ধা মহলের নিঃশব্দতা অন্যদিকে অপাত্রে দান করা, দলবৃত্তিক সাহিত্যের প্রচার প্রসারের অপপ্রয়াস। এই পরিস্থতিতে পাঠক ঠিক লেখককে খুঁজে নিবে এই দায়িত্ব সর্বাংশে পাঠকের উপর বর্তানোর কিছু নেই। পাঠকের পক্ষে সম্ভবও না। কারণ পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য মিডিয়া একটা বিশাল ভূমিকা নিচ্ছে। লিফলেট, বিজ্ঞাপন দিয়ে এখন সাহিত্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার চর্চা কমে গেছে। বরং স্বজনের প্রীতিময় সাহিত্য নামক আগাছা সর্বত্র। যারা একনিষ্ঠ সাহিত্যিক তারাও মানুষ। প্রত্যেক লেখক চান তাঁর লেখা পাাঠকের কাছে পৌঁছাক। নিষ্ঠাবান সাহিত্যিকও এই উপলব্ধিটুকুর বাইরে নন। কারণ লেখক- পাঠক উভয়-ই মানুষ। নেপথ্যের এই টানাপোড়েনে লেখকের কী রক্তক্ষরণ হয় না ? কত শক্তিমান লেখক এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছেন। অথচ কত আবর্জনায় ভরে গেছে সাহিত্যের তীর্থস্থান! এই যে জগদীশ, সতীনাথ, অমিয়, কমলকুমার, এমন কী শহীদুল জহির এঁরা যদি যথাসময়ে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারতো তাহলে কী বাংলা সাহিত্য আরও অন্তত পঞ্চাশটা বছর এগিয়ে যেতো না? আজ হয়তো, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, ঢোঁড়াই চরিত মানস, অন্তর্জলী যাত্রা, এমন কী শত বছর আগের পথের পাঁচালী, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শক্তভাবে বিশ্বে স্থান করে নিতো। নোবেলে এঁদের নাম আসতো। এ হতো বাঙালির অর্জন। বাঙালির প্রণোদনার শক্তি ।’ পথের পাঁচালী’ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে তবে উপন্যাস কেন পারলো না? উপন্যাস থেকেই তো চলচ্চিত্রের জন্ম! জজ্ঞালের স্তুপে অনেক ভালো সাহিত্য দমবন্ধ করে মরে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ আলোর স্ফূরণের মতো জেগে উঠছে। কিন্ত এই জায়গা থেকে দায় নিয়েই সাহিত্যকে আবর্জনামুক্ত করতে হবে সবার। ভালো লেখা পাঠকের কাছে দ্রুত সহজ করে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব সমাজকেই নিতে হবে। যথাসময়ে যথার্থ কাজটি করা জরুরি। না হলে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকের একশ বছর পিঁছিয়ে যাবার ইতিহাসের মত একটা যুগের পিছিয়ে পড়ার নতুন ইতিহাসও ভবিষ্যতে বারংবার শ্রেণিকক্ষে পাঠ করতে হবে। কত শক্তিমান, নিষ্ঠাবান লেখক আত্মাভিমান নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে! বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগের মতো আরও একটা যুগের আগমন অনিবার্য । যেখানে প্রতিযোগিতা, পারস্পরিক ভালোবাসা, উৎসাহ -উদ্দীপনা থাকবে, ঈর্ষা না, একদম না!! দলবৃত্তি না! একদম না!
শিক্ষাঙ্গন শিক্ষকদের ‘ শিক্ষক’ হয়ে ওঠার দীক্ষার পাঠ আবারও নেয়ার বিকল্প নেই। একমাত্র যথার্থ শিক্ষক-ই পারেন যথার্থ শিক্ষার্থী গড়তে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পরিচয় ফিরে আসুক স্বমহিমায়! শিক্ষক হয়ে ওঠুক বিশুদ্ধ শিক্ষক তবেই শ্রেণিকক্ষ হয়ে ওঠবে সহজ সাবলিল শিক্ষার্থী মুখরিত পবিত্র বিদ্যাপীঠ।
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং গবেষক।
মন্তব্য করুন