রফিকুল ইসলাম জসিম, নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এবার নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) সম্প্রদায়ের একজন কন্যা প্রথমবারের মতো সৈনিক পদে যোগ দিয়েছেন। এটি শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং পুরো পাঙাল সমাজের জন্য এক অনুপ্রেরণার বার্তা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে ইতিহাস গড়েছেন ফারাজানা আক্তার মুন্নী। তিনি আদমপুর ইউনিয়নের কোনাগাঁও গ্রামের মেব্বানী গুলনাহার বেগম বেণী ও মো. কামাল উদ্দিনের কন্যা। তার এই সাফল্যে পুরো এলাকা আনন্দে মুখর। একজন মণিপুরী মুসলিম মেয়ে থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক হয়ে ওঠা এই গল্প আজ তরুণ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার প্রতীক।
শিশুকাল থেকেই ফারাজানা মুন্নী দায়িত্বশীল জীবনযাপনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। স্কুলজীবনে তিনি ক্লাব, স্কাউটস এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি ইউনিসেফের শিশু অধিকার কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। করোনাকাল ও বন্যার সময় সীমিত সুযোগ সত্ত্বেও সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণে সক্রিয় ছিলেন।
ফারাজানা মুন্নীর মা গুলনাহার বেনী বলেন,ছোটবেলা থেকেই মেয়ের দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ছিল। একসময় ভাবতো, বড় হয়ে পুলিশ হবে। কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের বক্তব্য শুনে তার মনে নতুন স্বপ্ন জাগে দেশের সেবা করবে সেনা পোশাকে। এরপর ইন্টারমিডিয়েটের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সেনাবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়।
মেয়ের এই সাফল্যে আবেগভরে তিনি আরও বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল, মেয়ে আরও পড়াশোনা করবে। ছোটবেলায় সে বলত, ‘আমি বড় হয়ে পুলিশ হবো।’ পরে যখন জানাল, সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে, তখনও আমি খুশি হই। আজ সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য এটা শুধু আমাদের পরিবারের নয়, সমাজের, বিশেষ করে পাঙাল সমাজের জন্যও এক গর্বের বিষয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়ে ফারাজানার মা জানান, ট্রেনিং পাস করার পর একদিন ও বলেছিল ‘মা, ট্রেনিংটা অনেক কষ্টের ছিল।’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলেছিল, ‘এই কষ্টের মধ্যেও আনন্দ আছে। শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক দৃঢ়তা এবং অধ্যবসায়ের পরীক্ষায় সে নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে টিকে আছে। তিনি আরও বলেন, শুরুতে কিছুটা ভয় ছিল, এখন শুধু গর্বই আছে।
মা গুলবাহার বেনী বলেন, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা মেয়েদের খুব যত্নে রাখেন। ছেলে ও মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা এবং সুশৃঙ্খল। আমি নিজ চোখে দেখে এসেছি।
ফারাজানার মা গুলবাহার বেনীর বার্তা সমাজের অন্যান্য মেয়েদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের সমাজে অনেক মেয়েই আছে, যাদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের যোগ্যতা আছে। আমি তাদের বলতে চাই, ভয় পেও না, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবল থাকলে মেয়েরাও দেশের সেবা করতে পারে, ঠিক ছেলেদের মতোই। আমার মেয়ের সাফল্য যেন অন্য মেয়েদের অনুপ্রেরণা দেয়—এটাই আমার চাওয়া।
দেশ ও সমাজের জন্য কী অবদান রাখবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের প্রতিরক্ষা ও শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি, নিজের সম্প্রদায়—মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) সমাজের সেবা করার সুযোগ পেলে সেই কার্যক্রমে যুক্ত থাকবে৷
দেশ ও সমাজের জন্য অবদান প্রসঙ্গে মুন্নী মা বলেন, দেশের প্রতিরক্ষা ও শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করাই আমার মেয়ের প্রথম কর্তব্য। তবে শুধু তাতেই থেমে থাকতে চাই না। সুযোগ পেলে নিজের সম্প্রদায়—মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) সমাজের উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজেও যুক্ত করাবো৷
যুদ্ধ বা বিপজ্জনক দায়িত্বে মেয়েকে পাঠানোর প্রসঙ্গে মা বলেন, আমার মেয়ে যদি দেশের জন্য যুদ্ধে যায়, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় গর্ব। সে যদি বিজয়ী হয়ে ফিরে আসে, তা হবে দেশের ও আমাদের সমাজের সম্মান। আর যদি শহিদও হয়, তবু সে শহিদের মর্যাদা পাবে এর চেয়ে বড় সম্মান আর কিছু নেই।
ফারাজানা আক্তার মুন্নীর এই অর্জন প্রমাণ করেছে, উদ্যম ও সুযোগ পেলে সমাজের প্রান্তিক মেয়েরাও দেশের মূলধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এটি স্মরণ করিয়ে দেয়-সাহস, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম থাকলে মেয়েদের জন্য কোনো পথই অসম্ভব নয়।
আপনার মতামত লিখুন :