অ আ আবীর আকাশ
ইদানিং লেখালেখির বিভিন্ন মাধ্যমে আধুনিকতার নামে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণরূপে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। বিদেশি প্রতিটা কথা বা শব্দকে বাংলা উচ্চারণ দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে। একে বলা হচ্ছে বাংলিশ চর্চা। এটা কোন ধরনের আধুনিকতায় পড়ে জানা নেই। যা একান্তই বাংলা ভাষা ও ভাষা শহীদদের অপমানের শামিল। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ও বোয়াল মাছের সাথে পুঁটি মাছের নাচের মতোন কিছু অসাধু লেখক সাহিত্যিক নেচে যাচ্ছে। এ কারণে ভাষা শব্দ বানান এর পাশাপাশি উচ্চারণেও বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে।
আধুনিকতার আধিপত্যতায় হারাতে বসেছে- অ ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ ঙ ঞ ড় ঢ় ণ ৎ ং সব বর্ণের নিজস্ব ঐতিহ্য। হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে অপসাহিত্য বা কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে এদের ব্যবহার। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে শ ষ স এর ব্যবহারটুকুও সঠিক ভাবে হচ্ছে না। বর্ণগুলো হারাতে বসেছে তাদের নিজস্ব পরিচয়।
অ
অমুক না লিখে ওমুক, অখানে-ওখানে, অই- ওই, অজু-উজু, অকুল- ওকুল, আকিঞ্চন- ওকিঞ্চন ইত্যাদি বানান ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
ঈ বর্ণকে ই বর্ণের ভেতরে চেপে রেখে সাঈদ না লিখে সাইদ, মঈদ- মইদ, ঈশ- ইশ, ঈষান-ইশান, ইশা- ঈশা, ঈহমান-ইহমান, ঈহামগ্নকে-ইহা মগ্ন, ঈহিতকে-ইহিত ইত্যাদি বানান লিখে বিভ্রান্ত ছড়ানো হচ্ছে। বিশেষ দুইদিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে সম্প্রতি কিছু কিছু পত্রিকায় রশ্য-ই দিয়ে লেখা হচ্ছে।
ঊ বর্ণকে উ বর্ণের আড়ালে রাখা হয়েছে কি কারনে তা জানা যায়নি। তবে সংখ্যানক্রমিক লিখতে ইদানিং ঊ এর ব্যবহার অপমানজনক। ঊনিশ, থেকে শুরু করে ঊনত্রিশ, ঊনচল্লিশ, ঊনপঞ্চাশ এভাবে প্রত্যেক জায়গায় ঊন হলেই ঊ এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয় -ঊয় ঊর্ধ্ব ঊর্ধ্বতন ঊনবিংশ ঊর্ধ্বশ্বাস ঊর্ধ্বশায়ী ঊষা ঊহ্য ঊহ্যবাক্য ঊহ্যতা ঊষর ঊর্মিলা ইত্যাদি লিখতে মনে রাখতে হবে উ না হয়ে ঊ হবে।
ঋ বর্ণের ব্যবহার ইদানিং চোখেই পড়ে না। রি রী এর ভেতরে যেনো ঋ বর্ণ মরতে বসেছে। নবীন সমধারার এসব লেখক গোষ্ঠীর হাতে পড়ে অস্তমিত হওয়ার পথে ঋ বর্ণসহ অন্যান্য বর্ণ।
দিন দিন এসব বর্ণ তাদের জায়গা হারাতে বসেছে। ঋ দ্বারা শব্দ কত সুদৃঢ় হয় তা রি রী দিয়ে লেখলে এতো ঋদ্ধ হয়? কখনোই না। রি বা রী পার্থক্য কোথায় কত বিশাল তা লেখক গোষ্ঠী একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাবে। ঋতু ঋজু ঋণ ঋদ্ধ ইত্যাদি শব্দ কতো মজবুত তা রি বা রী দ্বারা সম্ভব না। এ শব্দগুলো বানানের পাশাপাশি উচ্চারণের দিক দিয়েও যে কত মানানসই তা বলাই বাহুল্য। লেখিয়েদের মনে রাখার বিষয় আসল বর্ণ বাদ দিয়ে নকল বর্ণে শব্দ সাজালে তা পরিপূর্ণতা পায় না, জৌলুস পায় না।
ঐ বর্ন নিয়ে সাধারন লিখিয়েরা বিপাকে। ঐ ডাকে ঐখানে ঐজন ঐমন এভাবে লেখা হলে এক ধরনের প্রুফরিডার আছেন তারা ঐ এর স্থলে ওই লিখেন। কিছু কিছু বানানে ঐ এর স্থলে ওই বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। তবে ঐক্য ঐতিহ্য ঐতিহাসিক ঐক্যবদ্ধ ঐকমত ঐকতান ঐশ্বর্য ঐশী ঐশ্বরিক ঐরাবতসহ এরকম আরো বহু শব্দ রয়েছে যা কোনোভাবেই ঐ বর্ণের স্থলে ওই লেখা বাঞ্ছনীয় হবে না।
এসব বানান নিয়ে খামখেয়ালিপনা হলে বাংলা ভাষা সাহিত্য সাহিত্যচর্চা হুমকির মুখে পড়বে। অযথা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে শব্দ বানিয়ে বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে কি লাভ!
ঔ বর্ণ দ্বারাও বাংলা ভাষার বিশাল আধিপত্য বিস্তার করে তা যথাযোগ্য প্রমাণ করে ঔষধ ঔপনিবেশিক ঔচিত্য ঔচিত্যবোধ ঔৎকর্ষ ঔৎসুক ঔরস্য ঔরসজাত ঔপন্যাসিক ঔদার্য ঔষাধালয় ইত্যাদি শব্দ বানানে আমাদের সঠিক ভাবে ঔ বর্ণের প্রয়োগ করতে হবে। তদুপরি ধারণা থাকতে হবে যে কোন শব্দটি ঔ বা কোন শব্দের ঔকার বসবে নইলে বর্ণের কারণে সাহিত্য হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়।
ঙ বর্ণ আরেক অবহেলিত বর্ণ হয়ে পড়েছে। ঙ প্রকৃতপক্ষে নিজের রূপ উচ্চারণ ভঙ্গি অপরের সহযোগিতা নিয়ে বদলাতে পারে। এর উচ্চারণ ও বানান দুটোই কখনো অনুস্বার কখনো গ এর মতো হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়-ভাঙা বাঙালি চোঙ কাঙ্ক্ষিত কাঙালি চাঙড়া চাঙারি ভাঙাচোরা ইত্যাদি বানান ঙ বর্ণ প্রয়োগ-ই সঠিক ও শুদ্ধ। মনগড়াভাবে শব্দ না জেনে বুঝে অনুস্বার বা গ বসালেই যথার্থ শব্দ গঠন, বানান, উচ্চারণ হবে না। কোলকাতার অভিধান, বাংলা একাডেমি অভিধান ও জয় বাংলা নবঅভিধান খুঁজেও ঙ বর্ণের ব্যবহার পাওয়া যায়নি। বাংলা একাডেমি মন্তব্য না করলেও কলকাতা একটি মন্তব্য করেছে ঙ বর্ণের ব্যাপারে। এই ক্ষুদ্র মন্তব্যের ভেতর দিয়েই হত্যা করেছে ঙ বর্ণটাকে। ঙ বাংলা ভাষার পঞ্চম ব্যঞ্জন বর্ণ এবং কণ্ঠ নাসিক্য ধ্বনি ঙ এর লিখিত রূপ। বর্তমানে ঙ এবং অনুস্বার উচ্চারণে অভিন্ন। বহু ক্ষেত্রে ঙ এর পরিবর্তে অনুস্বার লিখিত হয়।
আমি বলতে চাই ঙ এবং অনুস্বার উচ্চারণগত দিক এক হলেও লেখা শব্দশৈলী কখনই এক নয়। এতে কিছুতেই লেখার শ্রীবৃদ্ধি করতে পারে না। ঙ তার নিজস্ব আভিজাত্যে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে অনুস্বর তার নিজস্ব স্থানে প্রতীয়মান। কেউ কারো দোসর নয় বা তুলনা করে শব্দের ভান্ডার খালি করবে তা-ও নিতান্তই বেমানান।
ঞ বর্ণ বাংলা ভাষা হতে প্রায় বিলুপ্ত! কে রাখবে বাঁচিয়ে বর্ণকে? প্রবীণের পাশাপাশি নবীনরাও দৃষ্টি দিতে হবে এ বর্ণের প্রতি। ঞ শব্দের ভেতরে বা সম্মুখে বসতে না পারায় তার ঐতিহ্যগত দিক হারাতে বসেছে। কদাচিৎ দেখা মেলে শব্দের শেষে। এখন আধুনিকতার করালগ্রাসে সেখান হতেও বিচ্যুত। মিঞা ভূঁঞা পূর্বে লেখা হলেও এখন বানান পরিবর্তনে মিঞাকে মিয়া, ভূঁঞাকে ভূঁইয়া ইত্যাদি রূপ দেয়া হয়েছে। ঞ সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানীদের ধারণা-
ঞ বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের দশম বর্ণ। শব্দের আদ্যক্ষর রূপে এর ব্যবহার নেই। শব্দের ভেতরেও এর ব্যবহার নেই। যুক্তাক্ষরের মধ্যে দেখা যায় জঞ্জাট মধ্য বাংলায় এসে যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে আঞ্জি বানান পাওয়া যায়- গোসাঞি বাঁঞি।
বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট ধারণা না পেলেও ঞ নিয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ কোনো ধারণা করেননি। কোথাও খোঁজ থাকে না ঞ এই অবহেলিত বর্ণের। ঞতামি ঞাকুব ইত্যাদি লেখা গেলেও ই য় এর ভীড়ে ঐতিহ্যগত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে ক্রমে মৃত্যু হতে চলেছে ঞ বর্ণের।
ঢ় বর্ণ আরেক ক্ষোভানলে। র এর ভেতরে ঢেলে মনগড়া নিয়মে যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু সব মনগড়া নিয়ম কি আদৌ চলে? না কখনোই হয় না। জোর করে আধুনিকতার ভেতরে চেপে দিলেই কি শুদ্ধ হবে? তা কখনোই ভাষা বলে না। আষাঢ়, দৃঢ়সহ আরো নানা বৈধ শব্দ বানানে ঢ় এর ব্যবহার হলেও ভাষাবিজ্ঞানী এদের ব্যবহার এড়িয়ে গেছে। এ সুস্পষ্ট না হতে পারলে অভিধান প্রমাণ করে। শুধু তাই নয় ড় ণ ক্ষ অনুস্বার বিসর্গ ও চন্দবিন্দু ইত্যাদি বর্ণের ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে। কি কারনে, কোন নিয়মের ফলে এসব বর্ণের অবস্থা পরিবর্তনশীল তা বর্ণবিদ বা ভাষাবিদরাই ভালো জানেন। আগামী লেখিয়েরা কিভাবে সাহিত্যচর্চায় নিয়োগী হবেন তা একান্তই ভাবার বিষয়। বিদেশী ভাষাকে বাংলায় অনুবাদ না করে হুবহু উচ্চারণ বাংলায় লিখে সর্বত্রই এর প্রচলন করছে। আর এটাকে মনে করছে আধুনিকতা, পাণ্ডিত্য! এটাকে ভাষা জ্ঞানের পরিচায়ক মনে করে তারা মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে তা কি বাঙালি বোঝেনা?
তবে সুস্পষ্টভাবে কবি-সাহিত্যিকদের মনে রাখতে হবে শব্দকে আধুনিকতার নামে ওলট-পালট করে লিখে নিজের নাম চাঙ্গা করতে গিয়ে যেন কুপে না পড়ে। শুধু বানানে রাষ্ট্র সমাজ সাহিত্যে ও নিজের পরিচয়কে বড় করে তুলে ওলটপালট ভাবে লিখলে নিজের কাছে সাময়িক ভালো মনে হলেও অন্যের চোখে তা বেমানান। যা মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নেয়া হয়।
এসব বিষয়ে কঠোরভাবে কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকসহ লেখালেখির সর্বস্তর শ্রেনী মনে রাখতে হবে আধুনিকতার নামে শব্দ ভাঙা, নতুন নিয়মে লেখা, মনগড়াভাবে শব্দ বদল করা এসব যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এ সমস্ত বিষয়ে সঠিক ভাবে মেনে, চলে ও লিখলে তবে সাহিত্য ও ভাষা পরিপূর্ণতা পাবে। নয়তো লেখা বৃথাশ্রম ও প্রকাশ হওয়ার পাশাপাশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে।
লেখকঃ কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সম্পাদকঃ আবীর আকাশ জার্নাল
মন্তব্য করুন