মাহবুবুল আলম
করোনা মহামারির বৈশ্বক ভয়াল থাবা থেকে এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি পৃথিবীর মানুষ তার ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে করোনার নতুন ধরন বা স্টেইন ওমিক্রনের উপস্থিতি সারা পৃথিবীর মানুষকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে।
ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীদের কপালে স্পষ্ট হচ্ছে চিন্তার ভাঁজ। তা ছাড়া তাদের উদ্বেগের শেষ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞানীদের ধারনা, করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে রূপান্তরিত হয়ে নতুন এই রূপটি পেয়েছে। সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরন নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছিল৷
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার আবারও মানুষকে চরম উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট ২০২০ কিংবা ২০২১ সালের তুলনায় পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। ২০২০ খ্রীঃ করোনা মোকাবিলার আমাদের অনেক ঘাটতি ছিল ২০২১ সালে তা অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু ২০২২ সালে বাংলাদেশ অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কেননা, এরই মধ্যে শিক্ষার্থীসহ জনগণের বড় একটি অংশ টিকার আওতায় এসেছে। তাছাড়া সরকারের হাতে এখন
বিভিন্ন ব্রান্ডের ৯ কোটিরও বেশি টিকা মজুদ রয়েছে। যা সত্যিই স্বস্তির বিষয়। এ ছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখন আর কোনো সংকট নেই। এখন দরকার সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা। আর এ জন্য বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার বিষয়ে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হবে। তবে নানাজনের নানাহ কথা না শোনে সরকারকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার এ সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে হবে। করোনার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখা অবশ্যই সরকারের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। কিন্তু শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়াটা যেন নিরাপদ হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আমরা বরাবরই উদাসীন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি মানা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে বর্তমানে দ্রুত গতিতে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২০ সালে মহামারি শুরু হয় তখন সবার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। কিন্তু পুরোপুরি চালু হওয়ার পূর্বেই আমরা করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে প্রবেশ করেছি। পাশের দেশ ভারতে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অনেক রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আমাদের দেশে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাকেরাও সরকারের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন। করোনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কোনো সমাধান হতে পারে না। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। ইউনিসেফ বারবার সতর্ক করছে, আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে তা শিক্ষাব্যবস্থায় মহা বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এমনিতেই দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীর কতটা ক্ষতি হলো, তার সঠিক হিসাব আমাদের কারো জানা নেই। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুবই খারাপ ফল বয়ে আনবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে লাগল অনেক শিক্ষার্থী অনুপস্হিত। অনেক মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। মহামারির সময় কত জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে এবং কত জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজে যোগ দিয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। তবে এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় দুই লক্ষ শিক্ষার্থীর অনুপস্হিতি কিছুটা হলেও ক্ষয়ক্ষতির আভাস দিতে পেরেছে। কত জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে এবং কত জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজে যোগ দিয়েছে, তার সঠিক হিসাব বের করা প্রয়োজন।
ইতোমধ্যে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সামাজিক প্রভাব দৃশ্যমান এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবও শীঘ্রই প্রতীয়মান হবে। ইউনিসেফ বলেছে বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী সব সরকার সবার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই বেছে নিয়েছে। সব কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখা হলেও শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। প্রায় সব দেশেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সবার শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়া হয়েছে এর ক্ষতিকর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে।
করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত দুই বছরে প্রাক্-প্রাথমিক অর্থাৎ প্লে গ্রুপ ও নার্সারি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তো শিক্ষাজীবন শুরু করতেই পারেনি। জাতীয়ভাবে এই ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করা না হলেও আমাদের যাদের ঘরে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী আছে, তাদের কাছে ক্ষতির হিসাবটা সহজেই অনুমেয়।
মনোচিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বেড়েছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন, কোনো কিছু বায়না ধরে না পাওয়া, প্রেমঘটিত টানাপড়েন, আর্থিক সংকট, বিষণ্নতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যায়ও অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই কারণে ১৫০ জনের অধিক ছাত্র-ছাত্রির আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটিছে। তাই করোনা বেড়ে যাওয়ায় আবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদরা। তাদের
মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে ছাত্ররা বেশি ভাগ সময়ই বাইরে কাটায় তাই বাইরে থেকে করোনা বা অমিক্রনের ভাইরাস বয়ে নিয়ে আসতে পারে এমন কী পরিবারের সদস্যদের থেকেও ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে, তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক কলামিস্ট ও গবেষক
মন্তব্য করুন