।।মাহবুবুল আলম।।
করোনা প্যান্ডেমিকের ভয়াল থাবা থেকে এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি পৃথিবীর মানুষ তার ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে করোনার নতুন ধরন বা স্টেইন ওমিক্রনের উপস্থিতি মানুষকে আবার ভাবিয়ে তুলেছে, ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে ওঠেছে, তা ছাড়া তাদের উদ্বেগের শেষ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞানীদের ধারনা, করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে রূপান্তরিত হয়ে নতুন এই রূপটি পেয়েছে। সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরন নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছিল৷
এ বিষয়ে এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞদের কিছু মতামত বা আশঙ্কার কথা তোলে ধরছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ধরনটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক হিসেবে শ্রেনিভুক্ত করেছে৷ বি.১.১.৫২৯ ধরনটির নতুন নামকরণ করা হয়েছে ওমিক্রন৷ শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনকে নিয়ে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে৷ ধরনটিকে উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ৷
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারে বলা হয়েছে, প্রথমে এই ভেরিয়েন্ট পাওয়া গিয়েছিল বতসোয়ানায়। এরপর সেটি দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হয়। এর পরপরই সেটি শনাক্ত হয়েছে হংকংয়ে। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পরই দেশটির পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছিল। তারা বলেছিল, এটি আরও ছড়াতে পারে।
এই ভেরিয়েন্ট প্রসঙ্গে আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক টুলিও ডি অলিভেরিয়া বলেন, অস্বাভাবিকভাবে এটি রূপান্তরিত হয়েছে এবং অন্য যেকোনো ভেরিয়েন্ট থেকে এটি আলাদা। তিনি বলেন, ‘এই ভেরিয়েন্টটি আমাদের হতবাক করেছে।’ডি অলিভেরিয়া বলেন, সব মিলে ৫০ বারের মতো জিন বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে নতুন ওমিক্রন ধরন রূপ পেয়েছে। আর এর স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য বদলেছে ৩০ বারের বেশি।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, নতুন ভেরিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনের যে রূপান্তর, সেটা উদ্বেগের। কারণ, এর বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা বা টিকা নেওয়ার কারণে যে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা কাজ করবে কি না। তবে ইতালির শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট রবার্তো বুরিওনি বলেন, জনসাধারণের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত হবে না। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, এই ভেরিয়েন্ট নিয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি গুপ্ত বলেন, প্রতিরোধব্যবস্থা ঠিকঠাক সাড়া দিতে পারত না বেটার বিরুদ্ধে। এর থেকে বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু ডেলটার সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি ছিল। আর রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার বিরুদ্ধে এর ক্ষমতা ছিল মধ্যম মানের।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, এই ভেরিয়েন্ট নিয়ে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফাউসি। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ভেরিয়েন্ট ছড়াবে না, এমনটা করা হয়তো সম্ভব। তবে প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই ভেরিয়েন্টে সংক্রমণ কমাতে পারব?’
এই ভেরিয়েন্ট নিয়ে সিএনএনের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন আশিষ ঝা বলেন, এই ভেরিয়েন্টটি ভিন্ন আচরণ করছে। মনে হচ্ছে, এটি ডেলটা ভেরিয়েন্টের চেয়ে বেশি সংক্রামক। বিশ্ব জুড়ে ক্রমেই আতঙ্ক বাড়াচ্ছে করোনা ভাইরাসের (Coronavirus) নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন (Omicron)। দক্ষিণ আফ্রিকায় (South Africa)প্রথম আবিষ্কার হওয়ায় এই নতুন রূপ সবথেকে বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য় সংস্থা (WHO)। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম পাওয়া গেলেও ইতিমধ্যেই একাধিক দেশে করোনা আক্রান্তের শরীরে হদিশ মিলেছে এই নতুন প্রজাতির। বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, ইজরায়েল , হংকং ও ব্রিটেনেও হদিশ মিলেছে নতুন স্ট্রেনের। জানা গিয়েছে টিকাপ্রাপ্ত বয়স্করা এই ভাইরাস প্রজাতিতে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন।
সাউথ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিস-এনআইসিডি জানিয়েছে, তারা ২২ জনকে ওমিক্রন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করতে পেরেছে৷ এখন পর্যন্ত ১০০ এর কম জিন সিকোয়েন্স করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি প্রধান মারিয়া ভ্যান কেরখোভ৷ তিনি বলেন, ‘‘ভাইরাসটি যত ছড়াবে তার পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়বে৷ দেখা দিবে নতুন নতুন রূপও৷’’শুক্রবার পর্যন্ত বেলজিয়াম, ইসরায়েল, বতসোয়ানা ও হংকংয়ে ধরনটি শনাক্ত করা গেছে৷ জার্মানিতেও এরইমধ্যে ওমিক্রন পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছেন হেসে রাজ্যের মন্ত্রী কাই ক্লোজে৷ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সাউথ আফ্রিকা থেকে আগত এক পর্যটক করোনার ওমিক্রন ধরনে আক্রান্ত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷’’
কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার চিফ মেডিক্যাল অফিসার পল কেলি। তিনি বলেছেন নতুন ওমিক্রন্ট ভ্যারিয়েন্ট অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় যে ভয়ংকর, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে পল কেলি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ৩০০-এর মতো করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের সবার মধ্যে মৃদু লক্ষণ রয়েছে আবার অনেকের মধ্যে তা নেই। ’ অস্ট্রেলিয়াতে এরই মধ্যে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সাতজন রোগী চিহ্নিত করা হয়েছে । এর মধ্যে ছয়জন নিউ সাউথ ওয়েলসের, যা অস্ট্রেলিয়ার একটি জনবহুল রাজ্য। কেলি বলেন, ‘সারা বিশ্বে যারা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে তাদের বেশির ভাগ করোনার টিকা নিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে করোনার ভ্যাকসিন ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কাজ করবে না।’
ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চার হয়েছে। সে জন্য বিভিন্ন দেশ আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ধরনটিকে উদ্বেগজনক হিসেবে ঘোষণা করার পরপরই প্রথম উদ্যোগ নেয় যুক্তরাজ্য৷ সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে যাতায়াত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ইটালিও৷ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘‘সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আমরা অবহিত হয়েছি৷ এই ভ্যারিয়েন্ট খুবই অ্যাগ্রেসিভ৷ এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ এখনই স্থগিত করা হচ্ছে৷’’ তবে তাড়াহুড়া করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পক্ষপাতি নয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত নির্ভর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ তাদের৷
অনেক ভাইরোলজিস্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছন- ওমিক্রন নিজেকে যেভাবে বদলে ফেলেছে তাতে বিদ্যমান টিকাগুলো এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে৷ এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরো তথ্য সংগ্রহ করছে ডব্লিউএইচও৷ ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। গবেষকরা বলছেন, গবেষণাগার থেকে এর একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে। কিন্তু যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার সত্যিকারের উত্তর পাওয়া যাবে আসলে সংক্রমিত রোগীর পর্যবেক্ষণ করে। তাই এনয়ে এখনি আতঙ্কিত হওয়ায় মতো কিছু ঘটেনি। তাই মানুষকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সহিত চলাচল করতে হবে। এ ধরনের সংক্রমক ব্যাধিতে স্বাস্থ্যবিধি মানলেই কেবল নিজকে রক্ষা করা যায়।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন