মাহবুবুল আলম।।
আমরা যারা হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করি আর সে হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া আওয়ামীলীগের প্রতি পক্ষপাত; একই সাথে বর্তমান আওয়ামীলীগের কান্ডারী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনর প্রতিও ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এবং নিরঙ্কুশ সমর্থন। কিন্তু ২০২১ এ এসে আদর্শের সেই সংগঠনকে কিছুতেই যেন চিনতে পারছি না। বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির বনস্পতি এই বৃহৎ বৃক্ষটির ডালে ডালে পাতায় পাতায় কেমন যেন বৃক্ষধ্বংসকারি ছত্রাকে ছেয়ে আছে। গণমানুষের এই দলটিকে কেন জানি তার মৌলিক জনসম্পৃক্ততা ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারাচ্ছে।
মানুষ যখন দলটির বাজে সমালোচনা করে তখন খুব কষ্ট পেলেও জবাব দিতে পারি না। দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, জিডিপি বেড়েছে, বেড়েছে ব্যাংকের রিজার্ভ ও মাথাপিছু আয়, জীবন যাত্রার মানও বেড়েছে অনেক, পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দর, উড়াল সেতু, নিজস্ব স্যাটেলাইট, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন, খাদ্যশস্য, মাছ, সব্জি উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এমন আরো অনেক উন্নয়ন আছে, কিন্তু কিছু নেতা-নেত্রী, এবং কয়েকজন মন্ত্রীর বেফাঁস কথাবার্তা ও কাওয়া সমাগমের কারণে বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী অনেক সাফল্য ম্লান করে দেয়। তাছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, স্বৈরাচারী সরকারের মতো কোনো
পূর্ব ঘোষণা ছাড়া জ্বালানী তেলের দাম বাড়িয়ে পরিবহন মালিকদের কাছে নতিস্বীকার করে ২৭℅ ভাড়া বাড়ানো বিষয়টি মানুষ মেনে নিতে পারছে না।
এই প্রসংগে চট্টগ্রামের কৃষকলীগ নেতা অ্যাডভোকেট সাইফুল আযম সম্প্রতি এক প্রতিক্রিয়ায় খুবই আক্ষেপ করে বলেছেন যে, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার পদ্মাসেতু করেছেন , ঢাকার অসহনীয় যানজটে অতিষ্ঠ রাজধানী বাসীর জন্য মেট্রো রেলের ব্যবস্থা করেছেন, প্রতিটি শহরে উড়াল সড়ক ওড়াল সড়কের ব্যবস্থা করেছেন,চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বিশাল টানেল সৃষ্টি করে ঢাকা- চট্টগ্রাম-কক্সবাজারকে একসুত্রে গ্রথিত করেছেন,বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আকাশে উড়ছে,পারমানবিক বিদ্যুতের দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ , উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে দেশ , কিন্তু আপনি নিজেকে আওয়ামীলীগ নেতা দাবী করেন এলাকায় কি সুনাম কুড়িয়েছেন ? দলের জন্য কি করেছেন? আপনার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কে কি করছেন ? আপনার নেতারা রাতদিন কোথায় এত ব্যতিব্যস্ত ? তারা দুর্বলদের কাছে ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত নয়? প্রশ্ন আরও অনেক কিছুই উঠবে আগামী ভোটের আগে। তখন দলের পাশে এসব লুটেরা সুবিধাবাজরা থাকবেনা।…”
…সেই স্কুলজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে, তাঁর দর্শন, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে বুকে ধারন করে জীবনের এ পর্যায়ে এসেছি। দলকে ব্যবহার করিনি কোথাও কখনো, দলের জন্য নিজেকে ব্যবহার করেছি। দলীয় সুযোগ সুবিধা আদায়ের চিন্তা মাথায় আসেনি কখনো,নিজের মন-মগজ-মেধা-সময় সবকিছুকে দলের সুবিধার জন্য যতদুর সম্ভব ব্যবহার করেছি। মাঠ পর্যায়ে আমরা যা চিন্তা করতাম দলের হাইকমান্ডের চিন্তাও একই ছিল। চেতনায় ভাবনায় নীতি আদর্শের সেতুবন্ধন ছিল কেন্দ্র থেকে তৃনমুলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। এখনও দলের নীতি আদর্শ গঠনতন্ত্র কর্মসুচী,ঠিকই আছে কিন্তু নেতাকর্মীদের মধ্যে তার প্রতিফলনের ছিঁটেফোটাও দেখা যায়না- এমন নষ্টের দ্বারপ্রান্তে প্রানের দল আওয়ামীলীগ।দেশব্যাপী দল- ব্যবসায়ীরা যেভাবে মোটা তাজা হচ্ছে দল সেভাবেই হাড্ডিসার চর্মসার হয়ে পড়তেছে।” (আংশিক)
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই জ্বালানি তেলের এই দামের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোভিডের কারণে এমনিতেই দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই কষ্ট হচ্ছে। আর এখন তো তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ব্যয়, পণ্যের ব্যয় সব বাড়বে এবং এই বৃদ্ধি সমস্ত উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করবে। পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধিসহ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরকারে কারা বসে আছে জানতে ইচ্ছা করছে। এই জানতে চাওয়ার যৌক্তিক কারণও আছে। সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ালো ২৩% কিন্তু বাস ভাড়া বাড়ানো হলো ২৭%। এটা কোন যুক্তিতে করা হলো? তাছাড়া আমরা সবাই জানি দেশের প্রায় ৯০% গাড়ি গ্যাসচালিত, তাহলে সব ধরনের যানবাহনের জন্য কেনো ২৭% ভাড়া বাড়ানো হলো?
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এর জবাব দেবেন কীভাবে! সরকারের এমন গনবিরোধী কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ কিন্তু ক্ষোভে ফুঁসছে।
এমনিতেই গত দেড় বছর ধরে করোনার সর্বগ্রাসী থাবায় এমনিতেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়েছে। চাকুরি হারিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে মানুষের আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় লাগামহীনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। এ কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। চালের পাশাপাশি চাল, তেল ডাল, আটা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বাজারে ক্রমাগত বেড়েই চলছে তেল ও চিনির দাম। এখন ডিজেল ৬৫ থেকে ৮০, সয়াবিন ৮৫ থেকে ১৬০, চিনি ৫৫ থেকে ৯০, ডাল ৬০ থেকে ৯০। তার ওপর তেলের দাম বাড়ানোর সাথে সাথে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি এ যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’।
সরকারকে সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছেন মন্ত্রী, এমপি এবং উপদেষ্টারাই। গত বছর বিভিন্ন সভা সমাবেশে কয়েকজন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার মন্তব্যে দেশজুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়, বাদ দেননি তারা। এ জন্য সরকার বেকায়দায় পড়েছে।
মন্ত্রীদের নানা মন্তব্য ও বক্তব্যে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকেই বিব্রত। তারা একে অন্য মন্ত্রী এবং সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার বক্তব্য হিসেবেই দেখছেন। তাদের বক্তব্য অনেকক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক ও অতিকথন বলেও মনে করছে সরকারের দায়িত্বশীলরা। তাদের মতে, এমন অতিকথনে তারা নিজেরা যেমন হাস্যাস্পদ হচ্ছেন, তেমনি সরকারকে বিব্রত করছেন। একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী নব্য মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তদের কথাবার্তায় আরো সংযমী হয়ে কাজেই নিজের পরিচয় দিতে বলেন। তাদের মতে, জনগণ এখন অনেক সচেতন, কথায় আর চিড়ে ভেজে না, কাজ দিয়েই নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে।
শেষ করতে চাই এই বলে, আগের তিন আমলের শেখ হাসিনা সরকারের সাথে চতুর্থ মেয়াদের শেখ হাসিনা সরকারকে মিলাতে পারছে না মানুষ। এই সরকার ভূমিধস বিজয় নিয়ে( যদিও নিন্দুকেরা বলছে নিশিভোট) চতুর্থ বার ক্ষমতায় এসে যেন
টাল সামলাতে পারছেনা, যদিও এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যতিক্রম। তাছাড়া ব্যতিক্রমের মধ্যে দু’চারজন মন্ত্রী এবং কিছু ত্যাগী নেতাও আছেন হাতেগোণাই বলতে হবে। আমরা এই ঐতিহ্যবাহী দলটিকে ভালোবাসি, আমরা চাই আওয়ামিলীগ
তার পুরনো গৌরবে ফিরে আসুক।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক
মন্তব্য করুন