# প্রতি বছরই হাওরে জলমহাল সেচ হয়, নেই কোন পদক্ষেপ। জলমহাল সেচের কারনর পরিবেশ ও মৎস্য সম্পদ বিপর্যয়ের পথে # কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এ ভাবেই হাওর, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংশ হচ্ছে #
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, জামালগঞ্জ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার জলমহাল, বিল, ডোবা ও নদীর তলদেশ শুকিয়ে অবাদে মাছ ধরার মহা উৎসব চলছে। বিশেষ করে মৎস্যজীবী সমিতির নাম ভাঙ্গীয়ে অসাধু জলমহাল-বিল ব্যবসায়ী চক্রের নেতৃত্বে প্রতি বছরই চলে এমন উৎসব। এ সবের নেপথ্যে উপজেলা মৎস্য কমর্মকর্তা কামরুল হাসান এর যোগ সাজস রয়েছে বলে জানান হাওরের কৃষকরা। ওই কর্মকর্তা দীর্ঘ বছর ধরে জামালগঞ্জে থাকার সুবাদের জলমহাল, বিল ব্যবহারকারী ও জেলেদের সাথে গড়ে উঠেছে নিবিড় সম্পর্ক। মাঝ খানে কিছু দিন অন্য উপজেলায় গিয়ে আবার তিনি চলে আসেন জামালগঞ্জে। মৎস্য বিভাগের নাকের ডগায় অ-বা-দে জলমহালের তলদেশ শুকিয়ে মাছ নিধন করলেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
জলমহাল সেচের কারনে কৃষি জমিতে সেচ সঙ্কট সহ মাছের বংশ বিস্তার রোধ ও হাওরের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাকে আরও প্রবল করে তোলা হচ্ছে। মৎস্য বিভাগের লোকজনের সাথে গোপনে রফাদফা করে চক্রটি হাওর এলাকায় প্রতি বছরই এই অশুভ তৎপরতা চালিয়ে মাছের বংশ ধ্বংশ করছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। এ ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য বিভাগসহ দায়িত্বশীলদের কোন তৎপরতা না থাকায় অসাধু চক্রটি দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের এসব “অনৈতিকতার গুটি হিসাবে কাজ করে হাতে গুনা কয়েক অসৎ দালাল সংবাদকর্মী”। তারা এমন অবৈধ কর্মকান্ডের প্রতিবাদ বা পত্রিকায় রির্পোট না করে জলমহাল সেচের খবর পেয়ে বিলের পাড়ে গিয়ে মাছ ও গাড়ি ভাড়া নিয়ে আসার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এ সব অপকর্মের কথা অস্বীকার করে বক্তব্য দিতে সময় ক্ষেপন ও টালবাহানা করে পর-পর কয়েক দিন মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল হাসান বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
গত ফ্রেব্রুয়ারী’র মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত অবাদে বীর দর্পে চলছে জলমহাল-খাল-বিল, ডোবার তলদেশ সেচের কাজ। জলমহাল-বিল ও নদীর তলদেশ শুকিয়ে মাছ শিকারের কোন বৈধতা না থাকলেও জামালগঞ্জ উপজেলার পুরো হাওর এলাকায় ইজারাকৃত অধিকাংশ জলমহাল, খাল- বিল, জলাশয় শুকিয়ে মাছের প্রজনন ও বংশ বিস্তার রোধের পাশাপাশি জলমহাল গুলোকে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে কারও কোন নজরদারি না থাকায় দিন দিন বিপর্যয়ের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করছে। জল মহাল শুকিয়ে মাছ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আড়ৎ মাছ পাঠানোর কারনে এলাকার মানুষ দেশী মাছ বাজারে খুব কম কিনতর পাচ্ছেন। এ কারনে আর ক’ দিন পর মাছের দেশ সুনামগঞ্জে মাছের আকাল দেখা দেবে। স্থানীয়রা চাষ যোগ্য মাছও কিনে খেতে দাম থাকে হাতের নাগালের বাইরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর ইউনিয়নের চানপুর মৌজার নয়াখাল নাইন্দা বিল এর তলা শুকিয়ে প্রথম জলমহাল সেচের উদ্ভোধন হয় এ বছর। এতে খবর পেয়ে স্থানীয় ক’জন দালাল সংবাদকর্মী গিয়ে গাড়ি ভাড়া ও মাছ নিয়েই শান্ত হয়ে চলে আসে বলে জানান স্থানীয়রা। স্থানীয়রা মৎস কর্মকর্তাকে জলাশয় সেচের বিষয়ে বার বার জানালেও অদৃশ্য কারনে কোন পদক্ষেপ নেননি তিনি।
হাওর ঘুরে দেখা যায়, সোনাপুর গ্রামের সামনে নয়াখাল নাইমদা, বেহেলী ও বদরপুরের মাঝ অংশে কসমার বিল, তেরানগরের পাশে দৌলতা নদী, ছিছড়াবনি, লকড়ি, ঘনিয়ার বিল সহ অনেক জলমহালের তলদেশ সেচা হলেও এ প্রতিবেদক মৎস্য কর্মকর্তাকে জানালে কোন পদক্ষেপ নেননি। ফেনারবাঁক ইউনিয়নের বিনাজুরা ও উদয়পুর গ্রামের মধ্যবর্তী লড়কি বিল, দিরাই চাতল বিল, ফেনারবাঁক ও রাজাপুর গ্রামের মাঝে ছিছড়াউলী বিল ও মুসলিম রাজাপুর গ্রামের পশ্চিম পাশে ধলাপাকনা বিল খোঁজারগাঁও গ্রামের পার্শ্ববর্তী চন্দ্রঘোনা বিল, হটামারা গ্রামসংলগ্ন হকিয়াডুকি বিল, ভীমখালী ইউনিয়নের তেরানগর গ্রামের পাশে দৌলতা নদী, দেউতান বিল, লম্বা বিল-গোল বিল, ও বেহেলী ইউনিয়নের বদরপুর সংলগ্ন ঘনিয়ার বিল, বেহেলী বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে কসমার বিল, সদর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের সামনে নয়াখাল নাইন্দা বিল সহ এমন অনেক বিল আছে যে ২/৩ টি ছাড়া সব গুলোই বিলের তলা শুকিয়ে মাছ ধরা শেষ বলে জানান স্থানীয়রা। আবার কোন কোনটিতে মেশিন লাগানোর প্রস্তুতি চলছে। সংঘবদ্ধ মাছ শিকারী চক্র প্রায় সব বিলে অবৈধ পন্থায় জলমহালের তলা শুকিয়ে মাছ ধরা অব্যাহত রেখে মাছের বংশ ধ্বংস করছে বলে জানান কৃষকরা। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের নিরব ভুমিকায় নানান সমালোচনা চলছে।
হাওরের মৎস্য সম্পদ বিনষ্টকারীরা ও পরিবেশ ধ্বংসকারীরা জোট বেঁধে প্রতি বছরই এই কাজ করে। তারা পানির পাম্প মেশিন দিয়ে বিলের পানি সেচ করছে। এতে করে অনেক কৃষকরা তাদের ধানী জমিতে পানি দিতে না পারায় ধানের ক্ষেত নষ্ট হওয়ার পথে। ছিছড়াউলী সহ বিলের পানি শুকিয়ে মাছ ধরার কারনে অনেক কৃষকের কৃষি জমি পানির নীচে চলে যাওয়ায় জমি নষ্ট হতে চলেছে। কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এ ভাবেই হাওর, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংশ হচ্ছে।
জলমহালের খোঁজ নিতে বিলের পারে গেলে এ প্রতিবেদক কে দেখে সেচ কাজে থাকা এক ব্যক্তি তাড়াতাড়ি পানি সেচার পাওয়ার পাম্প বন্ধ করে দেয়। তখন বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যান।
জানা যায়, নয়াখাড়া নাইন্দা বিল ইজারা পেয়েছে সদর ইউনিয়নের লক্ষীপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, ছিছড়াউলী বিল ইজারা পেয়েছর নতুন চাটনীপাড়া মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, লম্বা বিল গোলবিল পেয়েছে উজান দৌলতপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি, কসমার বিলের ইজারা পেয়েছে গোপালপুর—চিলমারা সমবায় সমিতি। অন্যদিকে ঘনিয়ার বিলের ইজারাদার সাচনা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। তবে মৎস্যজীবী সমিতি নামকাওয়াস্তে ইজারা মালিক হলেও প্রকৃত মালিক হচ্ছে অন্যরা । জলাশয়ের ইজারায় আইনে মৎস্যজীবীদের পূর্ণ অধিকার দেয়া থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। সমিতির আওতাভুক্ত হাওর এলাকার গরীব মানুষদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রায় সব জলমহালই থেকে চেটে-পুঁচে মাছ শিকার করে খাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী চক্রটি।
জলাশয়ের তলদেশ শুকিয়ে মাছ শিকারের কোন বৈধতা না থাকলেও পুরো হাওর এলাকায় ইজারাকৃত প্রায় সব বিল শুকিয়ে মাছের বংশ বিস্তার রোধের পাশাপাশি জলাশয়ের পরিবেশ বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে কারও কোন নজরদারি না থাকায় দিন দিন বিপর্যয়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
বিল শুকিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি শিকার করে এক সমিতির সভাপতি বলেন, কাগজেপত্রে ইজারাকৃত বিলের মালিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। তবে আমরা নামে আছি কামে নাই। আমরা এর সাথে জড়িত নয়। যারা সাব লীজ নেয় তারাই প্রতি বছরই এমন আকাম করে যা নিয়মের বর্হিরভুত।
সদর ইউনিয়নের সোনাপুর-লালপুর এলকার কৃষক সুবেন্দু দে বলেন, নাইমদা বিল সেচার কারনে আমরার বোরো জমিতে পানি দিতে পারিনাই। ধান কম হইবো। আমরার হাওরে ২-৩ হাজার গরু আছে, এই গরুর পানি খাওয়ার জায়গা আছিন নাইমদা বিল, সেচ করার কারনে আমরার গরুগুলো পানি খাইতে পারেনা। কঠিন অবস্থায় আমরা আছি। সোনাপুর গ্রামের সমাজকর্মী মোশাররফ হোসেন বলেন, নাইমদা খাড়া বিল সহ হাওরের অনেক বিল সেচ করে মাছ ধরে মাছের বংশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। মা মাছ, ডিম ওয়ালা মাছে শেষ। এই মাছ গুলো থাকলে আমাদের হাওরে মাছের অভাব থাকতোনা। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কে জানালেও কোন কাজ হয়নি। দুই জন সাংবাদিক আসছিল তারা টিভির লগো ধরে নানান জাতের প্রশ্ন করছে, কৃষকরা উত্তরও দিছে এরা কোন সংবাদ প্রচার না করে জলমহালের ইজারাদারের সাথে অর্থের বিনিময়ে মিশে গেছে। তারা এমন অন্যায় দেখেও কোন পদক্ষেপ নেয়না। ভবিষ্যতে যেন হাওরে আর বিল জলাশয় সেচ না করা হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি। কৃষক মন্তাজ উদ্দীন বলেন, মৎস্য কর্মকর্তা ঠিক থাকলে বিল সেচ বন্ধ থাকতো। তাইনের সাথে যোগাযোগ কইরাই এসব আ-কাম করতাছে। আজিমুল, সতীষ চন্দ্র কর, সোলেমান মিয়ারা মৎস্য বিভাগ দালাল সংবাদকর্মীদের উপর ক্ষোভ ঝারেন।
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব সেক্রেটারী সিনিয়র সংবাদকর্মী বাদল কৃষ্ণ দাস বলেন, আমাদের চোখের সামনেই এমন অনেক জলমহাল, খাল- বিল শুকিয়ে মাছ ধরছে। বরাবরই এ রকম বিলের তলা শুকিয়ে মাছ ধরা হয়, এবারও হচ্ছে। কৃষকরা আমাদের কে জানোর পর আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে তালবাহানা করেন। এরই মধ্যে বিল সেচে মাছ ধরার কাজ শেষ করে তারা।
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অ: দা:) কামরুল হাসানের কার্যালয়ে পর-পর কয়েক দিন ব্যক্তব্য নিতে গেলে তিনি একটু পরে, বিকেলে, সন্ধ্যায় বক্তব্য দেবো বলে কয়েক দিন সময় পার করেন। কোন কোন দিন তার কার্যালয় বন্ধ ও খোলা অবস্থায় তাকে পাওয় যায়নি। ফোনে তিনি জানান তার উপর আনিত অভিযোগ মিথ্যা। তবে জলমহাল সেচ বন্ধ হচ্ছেনা কেন জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে জানান।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: শামশুল করিম কে মুঠো-ফোনে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, হাওরের বিল—ডোবা অথবা জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা আইনে নেই। জেলার সকল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের বলা আছে; স্ব-স্ব উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ, এবং মৎস্য কর্মকর্তাবৃন্দ বিষয়টি তদারকি করেন। তারাই এ সব বন্ধে পদক্ষেপ নেবেন।
মন্তব্য করুন