হবিগঞ্জের এক সময়ের খরস্রোতা সুতাং নদী এখন মৃতপ্রায়। দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করা, আর শিল্পনগরীর বর্জ্যে এ নদীটি যেন মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। পানি বিষাক্ত হয়ে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ছে নদী-খাল-বিল জলাশয়। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় হাজার হাজার জেলে। অন্যদিকে চাষাবাদে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। এ ছাড়া নদীর পানি ব্যবহার ক রে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে নদীপাড়ের মানুষ।
সরেজমিনে অলিপুর শিল্প এলাকার আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, স্বাস্থ্যঝুঁকির চরম শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, জেলার অলিপুরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকারখানার দূষিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে। এখানে গড়ে উঠা অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নেই প্রয়োজনীয় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি)। যেসব কোম্পানিতে ইটিপি রয়েছে সেগুলো অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না। সরকার ও পরিবেশ অধিদফতরকে দেখাতে যে, অনেক কোম্পানি ইটিপি স্থাপন করেছে।
কিন্তু এগুলো বন্ধ রেখে কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে। এ ব্যাপারে কোনও নজরদারি নেই পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্বশীলদের। এ সুযোগে অলিপুর শিল্প এলাকার ৩০-৩৫টি কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এ নদীতে। ফলে নদী তীরবর্তী বুল্লা, করাব, লুকড়া, নূরপুর, রাজিউড়াসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে কৃষি, স্বাস্থ্য ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।নদী তীরবর্তী করাব, ছড়িপুর, উচাইল, রাজিউড়া, সাধুর বাজার, মির্জাপুর, ঘোড়াইল চর, আব্দুর রহিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, শিল্পবর্জ্য দূষণে আক্রান্ত গ্রামবাসীর কথা। দেখা যায় সীমান্ত অতিক্রমকারী সুতাং নদীর পানি কালো কুচকুচে হয়ে আছে। পানি থেকে চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর দূষিত পানিতে মরে আছে জলজপ্রাণী।সুতাং গ্রামের বাসিন্দা মাহবুবুলসহ কয়েকজন কৃষক জানান, হাজার বছরের পুরনো এ নদীটি ড্রেজিংয়ের অভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিদের নজরদারির অভাবে বহমান এ নদীটি কালের আবর্তে বিলীন হতে চলেছে। পাহাড়ি ঢল ও অতিবর্ষণের ফলে ভারত থেকে আসা উজানের পানি ও পলি মাটিতে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে নদীটি।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে লাখাই উপজেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বোরো জমিতে চাষাবাদ হয়। নদীর পানির অভাবে প্রতি বছর চাষাবাদ করতে কৃষকদের হিমশিম খেতে হয়। এতে ব্যাহত হচ্ছে বোরো উৎপাদন।
লাখাই উপজেলার বাসিন্দা মো. আমিরুল ইসলাম আলম বলেন, ‘লাখাই উপজেলার মোট ১৪টি গভীর নলকূপ, ১৩৮টি অগভীর নলকূপ এবং ৪৮০টি পাওয়ার পাম্পচালিত মেশিন দ্বারা সেচ দিয়ে থাকেন কৃষকরা। সুতাং নদীসহ স্থানীয় খাল বিলের ওপর স্থাপিত হয় পানি সেচের এসব পাওয়ার পাম্পগুলো। ফাগুন মাসের প্রথম দিকে সুতাং নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মেশিনগুলো বন্ধ হয়ে গেলে উৎপাদন ব্যাহত হয়।’শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, ‘সুতাংসহ হবিগঞ্জের ৫টি নদী সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন হয়ে গেছে শুধু হবিগঞ্জের শিল্পায়নের জন্য। এই শিল্পায়ন এবং প্রবৃদ্ধি মানুষের জন্য। এখন যদি মানুষই না থাকে তাহলে ভোগ করবে কে? নদীর পানি কালো আলকাতরার মতো প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা দেখেছি নদীর পানিতে ব্যাঙ মরে ভেসে রয়েছে।’পাল বাড়ির মৃৎশিল্পী রণজিৎ পাল বলেন, ‘আগে নদীর মাটি দিয়ে কাজ করতাম, কয়েক বছর ধরে তা করতে পারছি না।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী সুভাষ দাশ বলেন, ‘দুর্গন্ধের জন্য ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করেও থাকতে পারি না। দীর্ঘদিন থেকে সুতাং নদীর লাখাইর অংশে প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ পুণ্যস্নানে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে এ নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ায় পুণ্যস্নানেও ব্যাঘাত ঘটছে।’
নূরপুর গ্রামের কিষানি জয়তারা বিবি বলেন, ‘ছোট খাল থাইক্যা এই গাংগে কত হাতরাইছি। অখন যে ফানি আছে ইতারে ফানি কওন যাইত না। কম্পানির নর্দমা আইয়া গাংগের ফানি অখন মবিলের মতো অইয়া গেছে গিয়া। ইতা ফানিত এখন মানুষ নামনতো দূরের কথা, কোনো পশু-; পাখিও নামে না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও খোয়াই ওয়াটার কিপার তোফাজ্জল সোহেল জানান, নদী, খাল, বিল, জলাশয়ে শিল্পবর্জ্য নিক্ষেপের ফলে এই অঞ্চলের পরিবেশে বিপর্যয় নেমে এসেছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব ধরনের শিল্পবর্জ্য ‘উৎসে পরিশোধন’ বাধ্যতামূলক হলেও এই অঞ্চলে তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। কলকারখানাগুলো শুরু থেকেই বেপরোয়াভাবে দূষণ চালিয়ে আসছে, যা সংশ্লিষ্ট গ্রামসমূহের বাসিন্দাদের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দেশের উন্নয়ন নয় বরং ধ্বংস ডেকে আনছে। তা সুতাং নদী এবং আশপাশের খাল বিলের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়।তিনি বলেন, ‘কৃষি, মৎস্যসম্পদ, গবাদি পশু ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কয়েকবার আন্দোলন করেছে স্থানীয়রা। পরিবেশদূষণের অভিযোগে মার লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিকে বন্ধ করে দিয়েছিল এলাকাবাসী। কিন্তু আবার গোপনে চালু হয়েছে কোম্পানিটি। পরিবেশ অধিদফতরের যোগসাজশে চলছে এসব অনিয়ম। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য থেকে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করে লাখো মানুষকে মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষায় সরকার এখনই যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে স্থানীয়দের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।’
সুতাং নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। সুতাং নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর লাখাই উপজেলার কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ReplyForward |
মন্তব্য করুন