নূরুজ্জামান ফারুকী হবিগঞ্জ থেকে।টানাবৃষ্টিতে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সাম্প্রতিক সময় পাহাড় ধ্বসে ১০জন আহতের ঘটনায় আতঙ্ক বেড়েছে কয়েক গুণ। পরিবেশবিদরা বলছে পাহাড়-টিলার মাটি কেটে নেওয়া, অবাধে বৃক্ষনিধন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের ভ‚তাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেওয়া ও তার ওপরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বসতি গড়ে তোলার কারণে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাহাড় ধ্বস রোধে পাহাড় কাটা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও সচেতনা বৃদ্ধির আহবান তাদের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার পানিউমদা, গজনাইপুর ও দেবপাড়া ইউনিয়ন নিয়ে দিনারপুর পরগণা গঠিত। দিনারপুরে বছরের অধিকাংশ সময় বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাগুলী দেখিয়ে পাহাড় ও টিলা কেটে উজার করছে একশ্রেনীর প্রভাবশালীরা। গত এক যুগে উপজেলার বেশকিছু সরকারী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় টিলা সম্পূর্ণ এবং আংশিক কেটে সমান করা হয়েছে। ফলে এসব পাহারটিলা ধ্বসে মৃত্যুর ঝুঁকি দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুগের পর যুগ ধরে এই পাহাড়ি অঞ্চল খ্যাত দিনারপুরে পাহাড়ের পাদদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছেন কয়েক সহ¯্রাধিক পরিবার। মুষলধারে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ে কিংবা পাদদেশে বসবাসরত বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায় কয়েকগুণ। স্থানীয়রা জানান- বিগত ৮ বছরে দিনারপুর পরগনায় পাহাড় ধ্বসে একই পরিবারের ৬ জনসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে দিনারপুর পরগণার পানিমউদা ইউনিয়নের গহীন পাহাড়ে পাহাড় ধ্বসে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের ৬জন নিহত হন। ওই ঘটনা এলাকার মানুষের মনে হলে এখনো আতকে ওঠেন। এমনকি ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে গজনাইপুর ইউনিয়নের শংকরসেনা গ্রামে পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে ২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তবুও ওইসব এলাকার অসহায় দারিদ্র দিন মুজুর মানুষ জীবন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে আসছেন। এদের পূর্ণবাসনে সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ অতীব জরুরী বলে মনে করেন সচেতন মহল। কামারগাঁও গ্রামের আবুল কালাম বলেন- টিলার নিচে আমার ঘর, গত কিছুদিনের টানা বৃষ্টিতে টিলার মাটি আমার ঘরে ভেঙে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছি, রাত হলেই আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় থাকি, কখন জানি পাহাড় ধ্বসে ঘরে পড়ে যায়।
বনগাঁও মীরটিলার বাসিন্দা জয়নাল মিয়া জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মীরটিলায় বসবাস করে আসছি, কখন যে পাহাড়-টিলা ঘরের উপর পড়ে যায় সে আতঙ্ক সবসময় আমাদের মনের ভিতর কাজ করে। কিন্তু দিনশেষে আমাদের তো অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। গত ৬ অক্টোবর ভোরে পাহাড় ধ্বসে আমার প্রতিবেশি ১০জন আহত হয়েছে, তিনটি ঘর ভেঙে গেছে। এ ঘটনার পর থেকে আমরা অনেক আতঙ্কে আছি।
গজনাইপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন- পাহাড় কাটায় প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোয়ার বাইরে। এর ফলে নবীগঞ্জ উপজেলার পরিবেশ পরিস্থিতি হুমকির মূখে পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে স্থানীয়ভাবে সচেতনা বৃদ্ধি ও নবীগঞ্জের দিনারপুর এলাকার শত শত পাহাড় টিলা রক্ষায় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। দিনারপুর কলেজের প্রভাষক মোশারফ আলী মিঠু বলেন- পাহাড়-টিলা বেশীর ভাগই কাটা হয়েছে আবাসিক প্রকল্প, বানিজ্যিক মার্কেট কিংবা ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি তৈরী-মাটি ভরাটের জন্য। পাহাড় কেটে উজার করে মাটি নেওয়ার ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে। বিলীন হচ্ছে জীব-বৈচিত্র ও পরিবর্তন হচ্ছে ভ‚মি মাপের। প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করলে পাহাড় কাটা বন্ধ হবে এবং পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা কমবে। পানিউমদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইজাজুর রহমান বলেন, আমাদের পানিউমদা, গজনাইপুর, দেবপাড়া ইউনিয়ন নিয়ে দিনারপুর পরগণা গঠিত। নবীগঞ্জ উপজেলার একমাত্র পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে দিনারপুরের খ্যাতি রয়েছে। আমার ইউনিয়নে পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় সহ¯্রাধিক পরিবার বসবাস করেন অন্যত্র তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তবে সরকার ঝুঁকিপ‚র্ণ স্থান চিহ্নিত করে বসবাসকারীদের পুর্নবাসন করা উদ্যোগ নিলে মৃত্যু ঝুঁঁিক এড়ানো যাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন- প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টি হচ্ছে পাহাড় টিলা। অনেক বছর ধরে আমরা দেখছি কিছু সংখ্যক প্রভাবশালীরা হবিগঞ্জের পাহাড়-টিলা থেকে মাটি-বালু কেটে পাহাড়কে ধ্বংস করে দিচ্ছে, বৃক্ষনিধন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের ভ‚তাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেওয়া ও তার ওপরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বসতি গড়ে তোলার কারণে অল্পবৃষ্টি হলেই কর্তণকৃত পাহাড়গুলো ধ্বসে পড়ছে ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটছে। প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠা পাহাড়-টিলা কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কঠোর আইন রয়েছেন। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে পাহাড় কাটা রোধ করা যাবে। এরফলে পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।
এ ব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) শাহীন দেলোয়ার বলেন- কিছুদিন ধরে টানা বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, এজন্য আমরা পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানুষের মাঝে সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি। পাশাপাশি ঝুঁকি বাড়লে নিরাপদস্থানে অবস্থানের জন্য জনসাধারণের উদ্দেশ্যে মাইকিং করা হবে।
মন্তব্য করুন