কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধিঃ
পূর্ব-পাকিস্তান চা-শ্রমিক সংঘের অন্যতম কর্মী, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাবেক সদস্য, প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা মফিজ আলীরঘনিষ্ট সহচর প্রবীণ চা-শ্রমিকনেতা শ্রীপ্রসাদ গৌড় এর মৃত্যুতে শোকসভা
অনুষ্ঠিত হয়েছে। চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে গত রোববার(১৮ জুন) বিকেলে ৫ টায় কমলগঞ্জ উপজেলার দেওছড়া চা-বাগানে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
চা-শ্রমিকনেতা শংকর রবিদাসের সভাপতিত্বে ও হরি নারায়ন হাজরার পরিচালনায়অনুষ্ঠিত শোকসভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন
সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীন মিল্টন, সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, প্রয়াত শ্রীপ্রসাদ গৌড়ের ছোট ভাই
রামনারায়ন গৌড়, চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক শ্যামল অলমিক, সদস্য বধুয়া রিকিয়াশন প্রমুখ। সভায় বক্তারা বর্তমান দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতির এই দুঃসহ সময়ে দৈনিক মাত্র ১৭০ টাকা মজুরিতে অনাহার-অর্ধাহারে জীবনযাপন করা চা-শ্রমিকদের বাজারদরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মজুরি, পূর্ণ বকেয়া মজুরি প্রদান ও সর্বাতœক রেশনিং চালুর দাবিতে চলমান আন্দোলন অগ্রসর করতে প্রয়াত শ্রীপ্রসাদ গৌড়ের মতো নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি।
প্রয়াত শ্রীপ্রসাদ গৌড়কে একজন নির্ভিক সাহসী চা-শ্রমিক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করে সভায় বক্তারা আরো বলেন, শ্রমিক স্বার্থে ভূমিকা পালন করার# কারণে বাগান কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে তাঁকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। বেআইনীভাবে চাকুরিচ্যুত হওয়ার পর তিনি আপোসহীনভাবে প্রয়াত মফিজ আলীর সহযোগিতায় শ্রমআদালতে মামলা দায়ের করে দীর্ঘদিন পর পুণরায় চাকুরি ফিরে পান। এছাড়াও লংলা চা-বাগানের শিশুলাল লোহার ও সেনকা লোহার নামের দুজন
শ্রমিকে চাকুরীচ্যূত করা হলে শ্রমআদালত ও উচ্চ আদালতে দীর্ঘ ১১ বছর মামলা পরিচালনা করে তাদের পূর্ণ বকেয়া মজুরিসহ তাদের চাকুরি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রেও শ্রীপ্রসাদ গৌড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
বক্তারা আরো বলেন, গত বছরের আগষ্ট মাসে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের খেয়ে না খেয়ে জানবাজী রেখে দীর্ঘ ১৯ দিনের লাগাতার কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ, রাজপথ-রেলপথ অবরোধের মতো কঠিন সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে দৈনিক ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে মজুরি ১৭০ টাকা কার্যকর করা হয়। সেই মজুরির মেয়াদও গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়ে গেলেও নতুন মজুরি কার্যকর করার প্রেক্ষিতে কোন উদ্যোগ নাই। এমন কি শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বকেয়া ৩০ হাজার ২০০ টাকা এরিয়াকে লামসাম হিসেবে মাত্র ১১ হাজার টাকা তিন কিস্তিতে প্রদানের কথা বলে শ্রমিকদের ঠকানো হচ্ছে। ১১ হাজার টাকার ১ম কিস্তি
প্রদান করা হলেও ২য় কিস্তি জুলাই মাসে এবং ৩য় কিস্তি দুর্গাপূজার সময় প্রদান করা হবে বলে মালিক সমিত ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। এভাবে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা শ্রমিকদের হক প্রায় ২০০ কোটি টাকা মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তৎপর। এভাবে মালিকদের স্বার্থরক্ষায় মালিক, সরকার ও দালাল নেতারা সমন্বিত হয়ে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখলেও ১৭০ টাকা মজুরি মেয়াদ ২০২২ সালে উত্তীর্ণ হওয়ার ৬ মাস অতিক্রান্ত হলেও কবে নতুন মজুরি কার্যকর হবে সে ব্যাপারে কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। গত বছরের আন্দোলনে ধরাশায়ী ও দেউলিয়া চা-শ্রমিক ইউনিয়নকে রক্ষা করায় মালিকপক্ষ ও সরকার এবং বিভক্ত দালাল নেতারাও স্ব স্ব লক্ষ্যে তৎপর। এপ্রেক্ষিতে সরকার প্রচলিত শ্রমআইন ও ট্রেড ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রকে লঙ্ঘন করে বেআইনীভাবে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শ্রমদপ্তরের কর্মকর্তাদের অর্পণ করে দালালদের পুণর্বাসিত করার নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছে। গণবিচ্ছিন্ন দালালরা পুণরায় ক্ষমতায় এসে লুটপাটের স্বপ্নে স্বীয় কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। সর্বোপরি মালিকপক্ষ তাদের সর্বোচ্চ মুনাফার নিশ্চয়তার জন্য পোষ্য দালালদের টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বাত্মক তৎপর। নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন গত আগষ্টে চা-শ্রমিকদের কর্মবিরতি চলাকালে ডিসি, টিএনও, শ্রমঅধিদপ্তরের কর্মকর্তা বাগানে বাগানে
ছোটাছুটি করার পাশাপাশি সরকারের এমপি, মন্ত্রী এমন কি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মায়াকান্না দেখালেও আজ শ্রমিকদের দুঃসময়ে কেউই খোঁজ প্রয়োজন মনে করছেন না এই দূর্মূল্যের বাজারে দৈনিক মাত্র ১৭০ টাকা মজুরিতে কি করে
একজন চা-শ্রমিক ৬/৭ জনের পরিবারের ভরণপোষণ চালাবে? অথচ এই কর্মকর্তারাই কর্মবিরতিকালীন সময়ে মালিকদের ভাষ্য মতে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার তথ্যে বিচলিত হয়ে দিবানিশী ভুলে কর্মরিবতি ভাঙ্গাতে গভীর রাতেও
তৎপর ছিলেন। চা-শ্রমিকরা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন রাষ্ট্র, সরকার আর মালিক সব সময়ই একপক্ষের। চা-শ্রমিক সংঘের নেতারা মালিক, সরকার ও দালাল নেতাদের শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান
জানিয়ে বলেন পূর্ণ বকেয়া মজুরি প্রদানসহ বাজাদরের সাথে সংগতিপূর্ণ ২০২৩-২০২৪ মেয়াদের জন্য মজুরি ঘোষণা, বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রমবিধি ২০১৫ অনুযায়ী উৎসব বোনাস প্রদান, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র,
সার্ভিসবুক প্রদান এবং ৯০ দিন কাজ করলেই সকল শ্রমিককে স্থায়ী করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপোসকামিতা ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ থেকে সৎ,সংগ্রামী, আপোসহীন, শ্রেণি সচেতন নেতৃত্বে সংগঠন ও সংগ্রাম গড়ে তুলে
দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।
মন্তব্য করুন